প্রবন্ধ

ওওকুরায়ামা ভবন এবং রবীন্দ্রনাথ

প্রবীর বিকাশ সরকার

ওওকুরায়ামা কিনেনকান বাংলায় যার অর্থ ওওকুরায়ামা স্মৃতিভবন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শিক্ষাবিদ, গবেষক ও তোওয়োও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ড.কুনিহিকো ওওকুরা ১৯৩২ সালে বন্দরনগরী ইয়োকোহামার ওওকুরায়ামা পাহাড়ের উপরে। স্থানীয় পাহাড়ের নামে হলেও প্রকারন্তরে কুনিহিকোর জীবন ও কর্মকান্ডের স্মারকভবনই এটি। জাপানের প্রথম “আধ্যাত্মিক-সংস্কৃতিবিষয়ক গবেষণা সংস্থা” তথা “ওওকুরা স্পিরিচুয়াল কালচার ইন্সস্টিটিউট” প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় হিসেবে প্রি-হেলেনিক শৈলীতে এই বাড়িটি নির্মাণ করান। বিস্তৃত জায়গা নিয়ে গঠিত ওওকুরায়ামা স্মৃতিভবনের চতুর্দিকে রয়েছে বিশাল বাগান। যেখানে দামি দামি বৃক্ষাদি ছাড়াও রয়েছে উমে, সাকুরা প্রভৃতি জাতীয় ফুলের অজস্র বৃক্ষরাজি। এখানে উমে ও সাকুরা ফুলের ঋতুতে অনুষ্ঠিত হয় বর্ণাঢ্য ফুলদর্শন উৎসব। এছাড়া এই উদ্যানে ১০ হাজার মানুষ জড়ো হয়ে প্রতিবছর উপভোগ করেন সঙ্গীতানুষ্ঠান, শিশুদিবসের উৎসব। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিপাটি এমন একটি স্থান জাপানেও বিরল।

১৯৮৪ সালে এই স্মৃতিসদনটি রক্ষাকল্পে য়োকোহোমা নগর প্রশাসন দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং নাম পরিবর্তিত করে বর্তমান নাম রাখা হয়। ১৯৯১ সালে স্থানীয় সাংস্কৃতিক সম্পদ হিসেবে ঘোষিত করে স্থানীয় প্রশাসন। এই ভবনের ভেতরে রয়েছে ১০টি সভাক্ষক, ৮০ আসনবিশিষ্ট শিন্তোও ধর্মীয় মন্দির জিনজার অনুকরণে নির্মিত মিলনায়তন, ৫৬ মিটার দীর্ঘ গ্যালারি। রয়েছে একটি বৃহৎ সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার। অভ্যন্তরভাগে কিছু সংস্কার করা হলেও বিংশ শতকের প্রারম্ভ যুগের আসবাবপত্র তেমনি সংরক্ষিত আছে। এখানে প্রবেশ করলে পরে অনুভব করা যায় একটি রোমান্টিক যুগকে যা মিলিয়ে গেছে অনেক আগেই।

এই ভবন এবং এর প্রতিষ্ঠাতার সঙ্গে দুজন নমস্য বাঙালির স্মৃতি গভীরভাবে বিজড়িত অনেকেই আমরা সেই ইতিহাস জানি না। একজন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্যজন টোকিও মিলিটারি ট্রাইবুনালের ভারতীয় বিচারপতি শিক্ষাবিদ ড.রাধাবিনোদ পাল যদিও তাঁর জন্ম বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলায় বৃটিশ যুগে। ১৯৫৩ সালে বিচারপতি এখানে এসেছিলেন তাঁর জাপানি বন্ধু এদেশের প্রথম আধুনিক প্রকাশনা সংস্থা হেইবোনশা পাবলিশার কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা, শিক্ষাবিদ ও মৃৎশিল্পী শিমোনাকা ইয়াসাবুরোওর আমন্ত্রণে। ড.কুনিহিকো ছিলেন শিমোনাকার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই ভবনে শিমোনাকা আয়োজিত আন্তর্জাতিক দর্শন বিষয়ক একটি আলোচনা সভায় ড.পাল ভারতীয় বেদ ও আইন বিষয়ে প্রবন্ধ পাঠ করেছিলেন। অবশ্য সেই ঘটনার স্মৃতি কিছু না থাকলেও স্মৃতিভবনের ইতিহাসে তথ্য হিসেবে উল্লেখিত আছে।

ড.কুনিহিকোর সঙ্গে গুরুদেব রবিঠাকুরের বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়েছিল ১৯২৯ সালে যখন টোকিওর মেগুরো শহরস্থ তাঁর প্রাসাদোপম বাড়িতে প্রায় এক মাস আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন তখন। রবীন্দ্রনাথ পাঁচবার জাপান এসেছিলেন এটাই ছিল তাঁর শেষ ভ্রমণ। কবিগুরু ড.কুনিহিকোর আতিথেয়তায় অত্যন্ত মুগ্ধ হয়েছিলেন। কুনিহিকোও যে কবির সান্নিধ্য পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন তা তাঁর এক স্মৃতিলেখায় জানা যায়। এই গভীর সম্পর্ককে চিরস্থায়ী করার জন্য তাঁর রচিত গ্রন্থসহ অনেক মূল্যবান জাপানি ইতিহাস, সংস্কৃতি, দর্শন, সাহিত্য, শিল্পকলাবিষয়ক গ্রন্থও উপহার প্রদান করেন কবিগুরুকে। অনুরূপ কবিও ভারতে ফিরে গিয়ে তাঁর স্বরচিত গ্রন্থাদিসহ দেড়শ বই ও একটি ভারতীয় নৌকোর মডেল প্রতি-উপহারস্বরূপ ড.কুনিহিকোকে পাঠান।

২০০২ সালের কথা। জাপান-বাংলা শিক্ষা-সংস্কৃতিক বিনিময় সম্পর্কের শতবর্ষপূর্তি বছর। একটি প্রবন্ধ লেখার জন্য তথ্য খুঁজছিলাম। স্বনামধন্য রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক ড.কাজুও আজুমার কাছ থেকে কিছু নিয়েছি। আরও কিছু তথ্য দরকার বিশেষ করে ১৯৬১ সালে জাপানে অনুষ্ঠিত রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ সম্বন্ধে। কিন্তু আজুমা স্যার এই সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলতে পারলেন না কারণ বয়স হয়েছে অনেক কিছুই ভুলে গেছেন। তাঁর বাড়িতে ১০ হাজার বাংলা বই আছে অধিকাংশই রবীন্দ্রাথের এবং রবীন্দ্রবিষয়ক। জাপানি তো আছেই। বললেন জন্মশতবর্ষের ইতিহাস জানার মতো গ্রন্থ আছে কিন্তু কোথায় আছে বলতে পারছেন না। তাহলে কোথায় গেলে জানা যাবে? স্যার বললেন য়োকোহামাতে আছে ওওকুরায়ামা কিনেনকান সেখানে কিছু পাওয়া যেতে পারে। ৪০ বছর পেরিয়ে গেছে তথ্য-উপাত্ত আছে কিনা কে জানে? ড.কুনিহিকো মারা যাওয়ার পর অনেক কিছুই বদলে গেছে, হারিয়েও গেছে।

দমে না গিয়ে খুঁজে বের করলাম ওওকুরায়ামা স্মৃতিভবনের ঠিকানা ও টেলিফোন নম্বর। ফোন করে জানতে পেলাম কিছু তথ্য আছে ওখানে। একদিন অফিস থেকে ছুটি নিয়ে গেলাম খাড়া পাহাড়ের উপরে অবস্থিত সুদৃশ্য কিনেনকান ভবনে। ভবনটি দেখে সত্যি অভিভূত হলাম! প্রাচীন-প্রাচীন একটা গন্ধ এসে নাকে লাগল সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই পুরনো আসবাব থেকে। ভেতরে প্রবেশ করে পরিচিত হলাম সেখানকার পরিচালক নেমোতোসান ও একজন গবেষক উচিকোশিসানের সঙ্গে। তাঁদের নেইমকার্ডে দেখলাম ওওকুরা স্পিরিচুয়াল কালচার ইন্সস্টিটিউট লেখা। বুঝতে পারলাম যে ড.কুনিহিকো না থাকলেও তাঁর প্রতিষ্ঠিত গবেষণা সংস্থাটি এখনো কার্যকর। উচিকোশিসান ভেতর থেকে যা যা এনে আমার সামনে রাখলেন তা দেখে বিস্ময়াভিভূত হলাম! খুব বেশি কিছু নয় কিন্তু যা টেবিলের উপর রাখলেন তা ছিল আমার ধারণার বাইরে। আরও অবাক হলাম কবিগুরুর ঢাউস একটি সাদাকালো চমৎকার আলোকচিত্র হার্ডবোর্ডে লাগানো আছে একটি কক্ষে। তার পাশেই রয়েছে উপহার হিসেবে প্রেরিত সেই নৌকোর মডেলটি একটি কাঁচের বাক্সে। উচিকোশিসান জানালেন এসব বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত হয়।

এই কিনেনকান ভবনে যা পেলাম তা যে আমার কাছে কতখানি মূল্যবান বোঝানো কঠিন। হয়তো সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কার করিনি কিন্তু এই আবিষ্কারের আনন্দ কোনোভাবেই কম নয়! নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হল! সাত হাজার মাইল দূরে একদিন রবীন্দ্রসভ্যতা এই দেশকে মাতিয়ে দিয়েছিল ভাবতেই রোমাঞ্চ অনুভব করলাম। উচিকোশিসান বললেন, রবিঠাকুরের জন্মশতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে যে “টেগোর মেমোরিয়াল এসোসিয়েশন” গঠিত হয়েছিল ১৯৫৯ সালে তার মূল দপ্তর ছিল এই ভবনে। কার্যকরী অফিস ছিল টোকিও মেজিরো শহরে। আবার এই ভবনের ভেতরেই একটি কক্ষে আলাদাভাবে ‘রবীন্দ্র গবেষণা কক্ষ’ স্থাপন করা হয়েছিল। এখানে রাখা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ প্রেরিত গ্রন্থ, উপহার; সমগ্র জাপান থেকে খুঁজে আনা অসংখ্য দলিলপত্র, ছবি যা এখন অধিকাংশই নেই। ১৯৭১ সালে ড.কুনিহিকো মারা যাওয়ার পর রবীন্দ্র আন্দোলনটাই স্তিমিত হয়ে গেল। ড.কুনিহিকোর ইচ্ছে ছিল “টেগোর মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন” গঠনের কিন্তু করতে পারেননি সেটা হলে পরে জাপানে রবীন্দ্রস্মৃতি জাদুঘর গড়ে উঠত বলে আমার বিশ্বাস। উচিকোশিসান আমাকে দু-তিনতলা পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল গ্রন্থাগারে নিয়ে গেলেন যেখানে রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষরসম্বলিত দেড়শ গ্রন্থ সংরক্ষিত আছে যদিওবা বইগুলো অনেকটাই জরাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। কয়েকটি বই হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখলাম এবং দারুণ আলোড়িত হলাম এই কারণে যে হয়তবা রবীন্দ্রনাথ এই গ্রন্থগুলো স্পর্শ করেছিলেন!

সেদিন কয়েক ঘণ্টা লাগিয়ে বেশকিছু ম্যাগাজিন, দৈনিক পত্রিকার কাটিং, গ্রন্থ, অপ্রকাশিত আলোকচিত্র এবং মাসিক “সাচিয়া” বা “সত্য” নামে ২২টি ট্যাবলয়েড পত্রিকা কপি করে নিয়ে এলাম। ছবিগুলো দেখে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে, সত্যি এই ব্যস্ততম ভোগবাদী দেশটিতে প্রায় অর্ধ শতাব্দী পূর্বে ঋষিতুল্য রবীন্দ্রনাথের শততম জন্মবর্ষ বিশাল ঘটা করে অনুষ্ঠিত হয়েছিল! ১৯১৬ সাল থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত জাপানে গৃহীত অনেক দুর্লভ ছবি খুঁজে পেলাম।

আবিষ্কারের আনন্দে সারা পথ আমি দারুণ উত্তেজনায় কাটালাম। বাসায় ফিরে দলিলপত্রগুলো পড়লাম কয়েক সপ্তাহ ধরে কঠিন জাপানি ও চীনা কানজি অক্ষরে লিখিত অজস্র প্রতিবেদন, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, স্মৃতিচারণ সবই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। তাছাড়া তাঁর প্রবন্ধ, গল্প, কবিতার অনুবাদ তো আছেই। প্রায় সাড়ে ৩ বছর ধরে বিশাল পরিকল্পনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের শততম জন্ম বার্ষিকী উদযাপনের খবর বহির্বিশ্বের আর কোনো দেশেই পাওয়া যায়নি জাপান ছাড়া। যদিও সেই কর্মকান্ডের ইতিহাস অধিকাংশই সংরক্ষিত হয়নি। জাপানের সবচেয়ে বড় এবং জাতীয় সংসদ গ্রন্থাগারেও তেমন কিছুই খুঁজে পাইনি, খুঁজে পাইনি অগ্রগণ্য রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক কাজুও আজুমার কাছেও। আরও জানতামই না যে ওসাকা, নাগাসাকি, কোবে, য়োকোহামা, কিয়োতো, নারা প্রভৃতি মহানগরেও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গবেষণা হয়েছিল, অনুষ্ঠান হয়েছিল। যদি ওওকুরায়ামা কিনেনকান ভবনে না যেতাম অনেক তথ্যই আরও কতকাল অজানা থাকত কে জানে! আমার এই পর্যন্ত প্রকাশিত ৩টি গ্রন্থে এইসব তথ্য তুলে ধরেছি।

১৯৫৯ সালে এই ভবনে “টেগোর মেমোরিয়াল অ্যাসোসিয়েশন” গঠিত হয়েছিল ঠিক সেই সালেই আমার জন্ম। আমার আগে সরাসরি বাংলাদেশ থেকে আর কোনো বাঙালি লেখক বা গবেষক এখানে এসেছেন বলে কোনো তথ্য নেই বলেই উচিকোশিসান জানালেন। কি জানি হয়ত আমি রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কার করব বলে ঐ সালেই নিয়তির বন্ধনে বাঁধা পড়েছিলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *