দীলতাজ রহমান
মানবতা এবং পাখবতার রজ্জু …
অস্ট্রেলিয়া থাকাকালীন একদিন দেখলাম আবীর একটা তেলচিটে প্লেটে কোয়েলের তিনটে ডিমের ছবি নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে। ডিম দেখার আগেই দেখলাম, আমার দীর্ঘ চেনা সে প্লেটের চল্টাওঠা দাগ, আমার বাড়ির জানালা, দরজা, বারান্দার গ্রিল। আর গ্রিলের জন্য ছবিতে আকাশ-টুকরোকেও মনে হচ্ছিলো, আমার বড় চেনা এক পরিসর!
আমি কমেন্ট বক্সে লিখলাম, এমনিতে বাড়ি কাজের লোক নেই, তার ওপর আবার এই আপদ কে জোটালো?
উত্তরে আবীর লিখলো, ‘আমি কিনেছি, আমিই পুষবো!’
আবীরের উত্তরটা মুখ ফসকে যে কাউকে যা তা বলা স্বভাবের রূঢ় আমাকে কিছুটা নমনীয় করলো। ভাবলাম, কোনো কিছু পুষলে মানুষের অন্তর তৃপ্ত হয়। সবরকম বোধের উন্মেষ ঘটে। পোষাপুষি সেই অর্থে ঠিক আছে। আবীর আমার ছোটবোন শারমিন সুলতানা রীনার পুত্র। সে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সায়েন্স পড়ে।
আবীরদের বাসায় আবীরের বড়বোন বাঁধনের বিড়াল পোষার অস্বাভাবিক নেশা। নিজের টাকায় খাবার কিনে দাঁড়িয়ে থেকে রাস্তার কুকুরদেরও খাইয়ে আসে।
ভাগ্যিস বাসাটা দোতলা। তাই বাসায় কোনো কুকুর এনে তুলতে পারেনি। তবে বিড়ালে তাদের বাসা ঠাসা বলে আমি নিজেই ও বাসার পথ মাড়াই না। আর আবীরও আমাদের বাসায় এসে থাকে বিড়ালের উৎপাত ছাড়া নির্বিঘেœ বসবাস করতে। সেই নির্বিঘœ অবস্থাকামীর দ্বারা যদি আমার নির্বিঘœ অবস্থায় বিঘœ ঘটে, বাড়ির অভিভাবক হিসেবে যত দূরেই থাকি না কেন, একটু শঙ্কা তো মনে বাজেই!
যথাসময়ে দেশে ফিরে, ঘরে ঢুকেই যে শব্দ শুনি শুনি, তা কোনোভাবেই ক‚জন নয়, রীতিমতো একলার চেঁচামেচি! বললাম, চেঁচানোর শব্দ আসে কোত্থেকে? বাসার কর্ত্রী চাকরিজীবি আমার ছোটকন্যা ফারজানা রহমান। তিনি বললেন, ‘আবীরের কেনা দুটি কোয়েল থেকে ক’দিন আগে একটা মরে গেছে। ওটা মরার আগে কোনো চেঁচামেচি ছিলো না। একটা মরার পর আরেকটা এইভাবে চেঁচাচ্ছে!’
কন্যার উত্তর শুনে মনে মনে ভাবলাম, এমন অবস্থায় মানুষ চেঁচালে যারা দোষ দেয়, তাদের সব বাড়ি একবার করে এই পাখিকে পাঠানো উচিত। কারণ প্রকৃতির শিক্ষাই হলো আসল শিক্ষা। এর বাইরের শিক্ষা আরোপিত এবং অসম্পূর্ণ শিক্ষা!
একবার ফেনীর নতুন বাড়িতে ক’টা দেশি মোরগ-মুরগির সমাগম ঘটাতে চাইলাম। এ-বাড়ি ও-বাড়ি খবর দিয়ে ক’টা সুস্থ মুরগি জোগাড় করতে পারলাম বটে। কিন্তু তাদের বিস্তার লাভের জন্য একটিও বীর্যবান মোরগ আর পাই না। শেষে পালে কয়েকটা মোরগ আছে চেনা এমন একজনকে লোক মারফত ডেকে এনে, সুগন্ধি জর্দ্দায় ডবল খিলি পান খাইয়ে, বাকি সে জর্দ্দার কৌটাসমেৎ হাতে তিনগুণ দাম ধরিয়ে দিয়ে বললাম, তোমাদের বাড়িতে মোরগ আছে জানি। একটি মোরগ পাঠিয়ে দিও।
মোরগ বিক্রি করলে ধারেকাছের পড়শির উপকার হবে, তাই হৃদয়ের ওপর এত বড় ফাঁড়া নিয়ে সে মোরগ বিক্রিতে আগ্রহী ছিলো না। কিন্তু হাতে তিনগুণ দাম কড়কড়ে নোটটা ফেরতও দিতে ইচ্ছে করলো না। এমন দশার ভেতর মোরগ একটা এনে দিলো বটে। কিন্তু সে মোরগ আমার নানান বয়সী একপাল মুরগি পরিবেষ্টিত থেকেও, একেবারে ধারেকাছে কোনো বাড়ি নতুন বাড়িতে নেই, তবু দূরের প্রতিবেশীর কোনো মুরগির কুনকুন একটু ডাক শুনতে পেলে, ককক্ক ককক্ক ক করতে করতে দৌড়ে চলে যায়। যেতে যেতে গ্রীবার পেখমে যে ভাবখানা তার ফোটে, যেন ভীষণ মহৎ উদ্দেশ্যে যাত্রা করছেন তিনি! মনেপ্রাণে তীব্রপণ, যেন আমি আসছি তোমাদের সব যাতনা বধে …।
বাড়ির মুরগিগুলো যেমন দানা খুঁটে খাচ্ছিলো, তারা তেমনি খেতে থাকে! কোনোটাই তাদের সে সবেধন একমাত্র নীলমনি মোরগের পথ আটকায় না। পিছনে পিছনে কম বয়সী দুই-একটা বোহেমিয়ান সে পতির সাথে বিহারেও যায় না!
অথচ মনুষ্য-আচারের বৈপরীত্য, মোরগের এসব অনাচার চোখে পড়ে অধিকারবোধের মতো প্রবল মর্মজ¦ালাটি আমার একলার প্রাণে ভীষণ তড়পাতে থাকে। আমি আমার চৌকশ সহকারিণী মমতাজকে ডেকে বলি, বিধাতা পুরুষ তাহলে নারীর ভেতর কেন এতো ঈর্ষা দিয়েছেন? স্বামী বা প্রেমিকপুরুষের মনোযোগ, ভালবাসা, যৌনক্ষমতা এবং তার সহায়-সম্পত্তি, স-ব, সব তার স্ত্রী বা প্রেমিকা নিজের সুরক্ষায় কেন রাখতে চায়!
কালে কালে নারী-পুরুষ উভয়েরই সম্পর্ক এবং জীবন বেদম ভারাক্রান্ত এই এমন একটি বিষয়ের অধিকারের চর্চা নিয়ে, যা শতবার দলিল করিয়ে নিয়েও নিশ্চিত থাকার উপায় নেই! তবু শুধু একে একটা ঘেরাটোপে বাঁধতে এ নিয়ে কতো হাদিস-কালাম, ধর্ম ও আইনের শক্ত শক্ত শর্ত প্রয়োগ!
প্রাণীজগতের এইসব কাÐ দেখেশুনে আমার তো ইচ্ছে করছে, জোর গলায় বলি, এই মোরগের প্রবণতা দিয়েই তো বিধাতা পুরুষমানুষ গড়েছেন। তাহলে আইনকানুন সেই ধাতে ফেলে, শর্তগুলো সেরকম আরো খোলাসা হতে পারতো। আর নারীগুলোকে বিধাতা কেন শুধুই মুরগির মেজাজেই বানাতে পারলেন না! যাদের শেয়াল-বেঁজি, কাক-চিলের মতো ভয়ঙ্কর প্রতিপক্ষের সাথে লড়াইয়ের তাগদ থাকলেও ঘরের পুরুষকে আটকানোর কোনো প্রবণতা, কোনো আগ্রহ-ভালবাসা থাকবে না!
পুরুষকূলকে কেবল তাদের ইচ্ছে মাফিক তারা সন্তানের বীজদাতা করে রাখা ছাড়াও হেলায়ফেলায় মাঠের ফসল তোলার চাষিগিরি, চাক ভেঙে মধু আনার মৌয়ালগিরির মতো আরো এমনি সব কাজের জন্য যদি পোষ্য মানে বশ করে রাখতো, সেটাই বেশ হতো। নারী তখন বনের অন্যান্য বন্য পশু ঘোড়া, গাধা, হাতি, জিরাফ, হরিণ ছাড়াও বাঘের দিকেও নজর দিতো ঘরে এনে পুষতে।
কারণ রাখাল সমূহ’র ভরণ- পোষণের মূল্য উসুলের চিন্তাও তখন নারীর মাথায় চলে আসতো নিশ্চয়! নিশ্চয় তখন রেওয়াজটাও ওনরকম হতো, যার দখলে যত বেশি পুরুষ থাকতো, সে নারী ততো বেশি সম্মানীয়, ক্ষমতাধারি!
এমন প্রথা-ই চালু থাকলে, ঘরের বাইরে থেকে টানাপাখা টানতে টানতে পুরুষ তখন বুঝতো স্ত্রী’র ওই দাবড়ে ধরে ভালবাসা, যতœ-আত্মি কী রক্ষাকবচ! এমন কি তার ওই আত্মঘাতী অধিকারবোধও তখন কী মধুর!
আসলে সৃষ্টি এবং রক্ষার প্রধান কাজটি যে নারীই করে, তা বাঘের দিকে তাকিয়ে নারীর পক্ষেই রায় দিন বিজ্ঞ বিচারক মÐলি!
কেন যে ঈশ^র স্বামীর ওই ঠুনকো, পতনজাত বীর্য রক্ষায় জীবন বিপন্ন করা অমন শাঁখের করাতের মতো করে দামি ঈর্ষাটুকু গুঁজে দিলেন সুজলা-সুফলা নারীর কোমল প্রাণের ভেতর, যাতে করে পৃথিবীর রূপই পাল্টে গেলো এবং যার মাত্রাতিরিক্ত প্রয়োগে সমাজও তাকে কখনো খল ঠাওরায়।
তাহলে শুরু থেকে নারীকে মানবতাবোধের চেয়ে পাখবতাবোধটা বেশি শেখাতে পারলে, পুরুষের সাথে নারীর সম্পর্কের আটোঁসাঁটোভাবটা কমে আসবে। তাতে রক্ষা পাবে অনেক সংসার। কোনো শিশুকে আর চোখের সামনে পোহাতে হবে না, মা-বাবার সম্পর্ক ভাঙার মর্মান্তিক যাতনা!
ঘরে বিপতœীক কোয়েলটি নিয়ে এইসব ভাবনার ভেতরে একদিন আজিজ সুপার মার্কেট যাওয়ার দরকার হলো। ড্রাইভার বাংলামোটরের জ্যাম এড়াতে কাঁটাবন হয়ে ঘুরে গেলো। এতে করে রাস্তার পাশে অপ্রত্যাশিতভাবে পাখির দোকান দেখে ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললাম।
কয়েক দোকানে খুঁজেও কোয়েল পেলাম না। শেষে এক দোকানে আধাখাস্তা তিনটে পেলাম। আমার দরকার একটি নারী কোয়েলের। ও, আমারই বা দরকার কোথায়? দরকার তো ওই মাথা গরম পুরুষ কোয়েলটার, যে আস্ত পৃথিবীর প্রতি মারমুখী হয়ে আছে! দোকানী নারী কোয়েল বলে যেটা দিতে চাইলো, আমার সন্দেহ যাচ্ছিলো না কোয়েল-নারীর আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য না জানা থাকায়। তাই দুটো একসাথে নিলাম।
সদ্য কেনা কোয়েল দু’টোই মুমুর্ষ ছিলো। তবু অনন্যোপায় হয়ে কেনা যেহেতু! দুপুর পেরিয়ে বাসায় এনে কোয়েল দুটোকে খাঁচার ভেতর ঢোকাতেই পুরনো কোয়েলটা মুহুর্মুহু একটা ছেড়ে আরেকটা যেভাবে ধরছে, তাতে আমি তো আমি, যে কোনো কারো তাজ্জব না বনে উপায় ছিলো না!
আবারও ভাবতে লাগলাম, তাহলে সেই তো মানুষেরই আর দোষ কী!
প্রায় বিশ বছর আগে আমারই এক প্রকৌশলী বান্ধবী ফেলে আসা দিনের কথা বলতে বলতে কখন তার পুরো ঝাঁপি খুলে গেছে, সে তা টেরই পায়নি! না হলে এমন করে আর ক’জন বলতে পারে, ‘মা মারা গেলে ক’দিন না যেতে বাবা আবার বিয়ে করতে চাইলেন। আমাদের চার ভাইবোনেরই তখন বিয়ে হয়ে গেছে। তাই আমরা ভাইবোনেরা সবাই মিলে মানা করলাম। কেউ কেউ বললামও, আপনি মারা গেলে আমাদের মা কি এরকম কথা বলতে পারতেন? ভাইয়ের বৌয়েরাও বাবাকে বললো, আব্বা আপনার কোনো অযতœ হবে না…।
কিস্তু আব্বা তবু বিয়ে তো করলেনই, তাও কোনখান থেকে এক কম বয়সী মেয়েকে বিয়ে করে আনলেন। তারপর আব্বার সকালে গোসল করার পানি আমরাই কল থেকে চেপে বাথরুমে পৌঁছে দিতাম। কিন্তু আব্বা সে বেটির গোসলের পানি চাপতে চাপতে বুকে ব্যথায় অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আব্বা অসুস্থ হলে আমরা সবাই হাসপাতালে আব্বাকে নিয়ে ব্যস্ত। আর খালি বাড়ি ফেলে বেটি ভেগে গেছে। ভয়ে। ভেবেছিলো, আমরা হয়ত তাকে দোষারোপ করবো, মারবো!
আব্বা হাসপাতাল থেকে আর ফিরতে পারেননি। তারপর আব্বার কুলখানির আগেই ভাইয়েরা সে বেটিকে খুঁজে কাবিনের টাকা শোধ করে আসছে, আব্বাকে দায়মুক্ত করতে!’
পাখির কাÐকারখানা দেখে ক’দিনধরে এই গল্পটিও আমার মন থেকে মাথায় উঠে কাকের মতো ঠোকরাচ্ছে। এখন ভাবছি, এই কাহিনীর সবই ঠিক ছিলো, খালি যার গোসলের পানি তাকে চেপে নিতে বললেই হতো! আর বাপের কাবিনের টাকা ছেলেমেয়েদের হাতে শোধ হওয়াটাও একটু কেমন যেন ঠেকে। তাই মানুষ বোধহয় এইখানেই এসে ঠেকে গেছে! পাখি হতে তার এখানেই বড় বাঁধা!
শেষ বয়সে আরেকটি বিয়ে করলে, পিতার ¯েœহ-মমতা ভাগ হওয়ার সাথে, জন্ম নেয়া নতুন শরিকের হাতে চলে যায় সম্পত্তির সমান ভাগও।
শেষে এই মানবিক আর পাখবিক দুইরকমের দুইটি বিষয় রজ্জুর মতো আমার সমস্ত চৈতন্য এক করে একটানা পাকাতে লাগলো।
সেদিন নতুন পাখি খাঁচায় ঢোকানোর পর, বাকি সেটুকু বেলা আর চেঁচামেচি শোনা গেলো না। কিন্তু রাত একপ্রস্থ পার হতেই আবার একটার প্রাণঘাতী চিৎকার! চিৎকারের কারণ জানতে চাইলে, মাত্র একদিন আগে কিশোরগঞ্জের কোনো এক গ্রাম থেকে কাজের জন্য আসা ষাটোর্ধ্ব মহিলা, যাকে ইতোমধ্যে খালা বলে ডাকতে শুরু করেছি, সে-ই বললো, ‘এইহানো ব্যাডা দুইডা, আর মাইয়া একটা! এক মাইয়ারে লইয়া, দুই ব্যাডার খুনাখুনি…!’
আমি সে মৃত্তিকাঘনিষ্ঠ জীবনের অধিকারিনী খালাকে সাক্ষী মেনে বললাম, কিন্তু তুমিও তো দেখলে, আনার সাথে সাথে পুরান কোয়েল যা আচরণ করলো, তাতে তো মনে হলো, নতুন দুটোই মেয়ে!
খালা বললো, ‘তহন কি আর ব্যাডা চোউখ দিয়া দ্যাকছে? এহন যহন মাথার আগুন কমছে, এহন দিশা বাইরাইছে!’
আমি বললাম, তাহলে ঠ্যাকায় পড়লে পাখিও সমকামী হয় বলছো?
সমকামী শব্দটি আগে না শুনলেও খালা ফেরে পড়ে বুঝে গেছে। শেষে আমার দিকে তাকিয়ে সরুচোখে বললো, ‘দ্যাকলা তো নিজের চোউখ্খে!’
এরপর আর সময় ক্ষেপণ চলে না। আমি খাঁচার কাছে গিয়ে দেখলাম, নতুন দুটোর একটার মাথা বেয়ে রক্ত পড়ছে এবং যন্ত্রণায় সে মাথা তার ঘাড়ের ভেতর সেঁধিয়ে আছে। বুঝলাম ঘায়েল হওয়াটা নতুন পুরুষ! যদিও এই কতল হওয়া মাথা নিয়ে নারীঘটিত বিষয়ে এর পুরনোটার সাথে প্রতিদ্ব›িদ্বতায় যাওয়ার সাহস-ক্ষমতা কোনোটাই আর হবে না, তবু জহীরকে ডেকে বললাম, এটাকে জবাই করে আনো।
জহীর সেটা জবাই করে চামড়া ছিলে, একটুকরো কাগজে মুড়ে ঢিল ছোঁড়ার মতো করে ডিপফ্রিজে ছুঁড়ে মারলো। আর খালা ছুটে এসে তু তু করে বললো, ‘জবাই না কইরা ছাইড়া দিলে কি অইলো অইলে?’
আমি বললাম, মায়া লাগতেছে?
খালা উত্তর দিলো, ‘অয়ও!’
বললাম, মুরগি খাও না? গরু? হরিণ? মোষ? তখন মায়া লাগে না? এটাও তো টাকা দিয়া কিনছি! তাই একসময় ভেজে খেয়ে ফেলবোনে!
খালার চোখ ভিজে উঠলেও এতোটা ভয় পেতাম না! কিন্তু দাবানল শেষের বন আমি দেখেছি। পুড়ে কয়লা হওয়া গাছ থেকেও ডাল জন্মে। ভয়ঙ্কর সে দৃশ্য! তাই আপাতত সেখান থেকে সরে গিয়ে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঠেকালাম।
এরপর এক খাঁচায় সুখে-শান্তিতে বাকি কোয়েলদ্বয় বসবাস করলেও আবীরের তাতে আর আগের মতো আগ্রহ টের পেলাম না। জীব-জন্তু, পশু-পাখি পুষতে আমারও ভালো লাগে। কিন্তু তা মনে মনে। কারণ অত বাহুল্য সময় আমার জীবনে কোনোকালে ছিলো না, যে, নিরালায় বসে পাখির অধিক নিজের সাথেও দুটো অনিবার্য কথা বলি!
এই ক’দিন আগে আবীরকে বললাম, একমাস না যেতেই খালা তো তার নাতিপুতির টানে চলে গেছে। তুমি যেহেতু কিনেছো, এখন পাখিকে ঠিকভাবে খাবার দেওয়া, মাঝে মাঝে তোমার সাথে বাথরুমে নিয়ে তাদের গোসল করানো এবং সাধারণভাবে পরিষ্কার করার দায়-দায়িত্ব তোমার। না হলে কিন্তু গোনাহ হবে। পশু-পাখি পুষলে তা দরদ দিয়ে পুষতে হয়। আর গোসল মানে তো, তুমি নিজের গোসলের সময় খাঁচাসহ ওদেরকে তোমার পায়ের কাছে রেখে দিলে শাওয়ারের ছিঁটে আসা পানিতেই ওদের গোসল হয়ে যায়…।
আবীর গলা ঝাড়া দিয়ে বললো, ‘এবার তো আপনি কিনছেন! আমি আগেরবার কিনছিলাম!’
আমি বললাম, ওম্মা, তাই নাকি? তোমার কেনা পাখি একটা মারা যাওয়াতে আরেকটার চিৎকারে টিকতে না পেরে বিরহী সে পাখির প্রতি মায়া, আর তোমাকে সম্মান করেই না এতো হ্যাপা করে আমি কিনলাম, আর তাতেই আমার দোষ?
আবীর বললো, ‘তয় কি? আমি কি আবার কিনতে গেছিলাম নাকি?’ বুঝলাম, তার মোহ টুটগিয়া! তবু খাবার ফুরিয়েছে দেখে, সে দু’দিন আগে পান্থপথ বাসা থেকে হেঁটে হেঁটে যাওয়া-আসা করে কাঁটাবন থেকে পাখিদের খাবার এনেছে। কিন্তু খাবারই তো শেষ কথা নয়! পাখি বেচারিদের পুরোপুরি যতœ হচ্ছে না দেখে আমার মনটা খুব কাতরাচ্ছিলো। কী করি, কাকে দিই! যাকে তাকে তো পোষা পাখি দিলে হবে না। দিতে হবে যে এগুলোকে ভালোবাসবে। আবার যাকে দেবো সে হতে হবে আমাদের ভালোবাসার মানুষ!
একটি চ্যানেলের নামকরা সাংবাদিক, আদিত্য শাহীন ও ‘পারি’ পত্রিকার সম্পাদক লাইলা খালেদার বৃক্ষপ্রেম দেখে, আদিত্য’র স্ত্রী লাইলাকেই বললাম, আমার একজোড়া কোয়েল আছে। তোকে দিতে চাই।
সে বললো, ‘দেন আপা, খাবার কিনে নিচে কেয়ারটেকারদের কাছে রাখবো …। ’ লাইলার কথায় মনটাতে একটু মোচড় দিয়ে উঠলো। মনে মনে ভাবলাম, এত কম যে ভালবাসবে, অথবা বাসবেই না, তাকে এতদিনের পোষা পাখি সমর্পণ করা যাবে না! লাইলাকে দিলে নতুন কিনে দেওয়া যায়।
পথের ভেতর আবীরের মা’র কথা মনে হলো। তিনি আবার ইদানীং ছড়া লিখে বেশ খ্যাতি পেয়েছেন। সেই সুবাদে ফোনও ব্যস্ত থাকে। মানে বন্ধু-বান্ধব বেড়ে গেছে। তবু তাকে ফোন দিয়ে সাথে সাথে পেয়ে গেলাম এবং বললাম, আবীরের পাখি জোড়া তোমরা রাখো। ছড়াসাহিত্যিক তিনি বললেন, ‘আমাদের ঘরভরা বিড়াল। সমবেত হয়ে তারা খাঁচার শিক ভেঙে একলহমায় ও দুটোকে কাড়াকাড়ি করে খেয়ে ফেলবে!’
সব শেষে মন এক ভিন্নমুখ খুঁজে পেলো, কোয়েল গ্রহীতা হিসাবে যে হবে সেরা উপযুক্ত। কবি অঞ্জনা সাহার তিন বছরের পৌত্রীর মুখ মনে পড়লো। সাথে সাথে দ্বিতীয়, তৃতীয় মনও, মানে একটা মানুষের যে ক’টা মন থাকে তার সবই এসে এইমুখের পক্ষে সায় দিলো।
আবীরকে ডেকে বোঝালাম, পাখি পোষা দোষের নয়, যদি তুমি তাকে ভালোবাসো। পাখির কাছ থেকে আকাশ ছিন্ন করে খাঁচায় ভরেছো, ঠিক আছে। কিন্তু তাকে ভালোবাসা দিয়ে তো তা পুষিয়ে দিতে হবে! বন্দিত্বেও যে কেউ কিছুটা সার্থকতা খুঁজে পেতে পারে, যদি তার মনে হয়, শুধু ভালোবাসতেই কেউ আমাকে বন্দি করেছে। কিন্তু ভালো না বেসে অবারিত স্বাধীনতা থেকে যে কাউকে বন্দি রাখলে তো নিজেরও একটি যাতনা তৈরি হয়। না কি?
আবীর বললো, ‘ঠিক!’
আমি আবীরের অনুমতি পেয়ে কবি অঞ্জনা সাহাকে বললাম, আমি যে কোনো সময়ে তোমার বাসায় একটি জিনিস দিতে আসবো। এই প্রতিশ্রæতির পর সময়ের অভাবে কবিকে দু’দিন অপেক্ষায় রাখতে হলো। তারপর যখন গেলাম, পৌত্রী অদ্বিতীয়া রাই দরজার কাছেই ছিলো। আগে খাঁচাটা নজরে পড়তেই ওইটুকু রাই, সেও বুঝতে পারলো ভেতরে পাখি আছে!
তারপর তার বাড়ানো দু’হাতে গ্রহণের ভেতর দিয়ে আমার পাখি সমর্পণের কাজটি মধুরভাবে সম্পন্ন হলো। বুঝিয়ে দেয়া হলো পাখির বাকি খাবারও। যা সে এ বাড়িতে থাকলে আরো ক’দিন খেতো।
এদিকে চাকরিজীবি মেয়ে-জামাই দুজন দু’দিন রান্নাঘরের বারান্দায় গিয়ে কোয়েলদ্বয়কে দেখতে না পেয়ে, আলাদাভাবে একই কায়দায় অবাক চোখে জানতে চাইলো, ‘পাখি গেলো কই?’ আমি দু’জনকে একইরকম করে উত্তর দিলাম, কবি অঞ্জনা সাহার পৌত্রীকে গছিয়েছি!
দুজনেই সেই একইভাবে অনিবার্য আরেকটি প্রশ্ন করলো, ‘আবীর কিছু বলেনি?’
আমি সেই একইরকম করে দ্বিতীয়বার আরেকটি যে উত্তর দিলাম, বললাম, আবীরকে বুঝিয়েছি, ভালোবাসার বিনিময়ে কাউকে বন্দি রাখা যায়। কিন্তু অবহেলা করে তো বন্দি রাখার দরকার নেই! কোয়েল দু’টিকে তাকেই দিই, যে ওদের ভালোবাসবে…!
কথা শেষ না হতেই দু’জনেই তাদের শেষের প্রশ্নটি ঝেড়ে দিয়েছে, ‘আবীর কী বললো?’ তিন নম্বর প্রশ্নটিও সেই আমার একইরকম। বলি, ও তো এমনভাবে ‘দ্যান’ বললো, যে দিতে পেরে বাঁচলো বলে মনে হলো।
আর যেটুকু শোনার জন্য কেউ-ই অপেক্ষা করে না, তা হলো, যে কাউকে প্রতিদানহীন একটানা ভলোবেসে যাওয়া সোজা কথা নয়। সে পাখিই হোক, গাছ কিংবা মানুষ!
কোয়েল অবশ্য ক’দিন বাদ দিয়ে আবার একটানা ক’দিন একটি করে ডিম্ব দিতো। কিন্তু নর্থ সাউথে লাস্ট ইয়ারে পড়া একজন ছাত্রের প্রতিদিন অনেকখানি করে অভিনিবেশ পেতে মাঝে মাঝের সে ডিম্ব আর প্রতিদান হিসেবে কতোটুকু!
গল্পটি এখানেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু আবীর আজ মেসেজবক্সে লিখে রেখেছে, ‘একটা জবাই করা কোয়েল দেখলাম ফ্রিজে! আপনি কি কোয়েল দুটো আসলে কাউকে দিয়েছেন, না কি, না দিয়েই দেওয়ার মিথ্যে গল্প লিখেছেন?’
গল্পটি লিখে খাবার টেবিলে সবার সাথে তা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। আবীর তা ভোলেনি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ওর ওই ক্ষুদে বার্তা দেখে মাথায় রক্ত চড়ে গেলো আমার। আমি তার খালা, মানে মায়ের বড় বোন! তাও তার মায়ের পিঠাপিঠি বড় বোন নয়, মাঝখানে আরো দু’জন আছে! তাই ভাবছি, সম্পর্কের এই বিশাল ভার আর বয়সের দুস্তর ব্যবধান অমান্য করে সে আমাকে এমন কথা লিখতে পারলো কি করে?
তড়বড় করে গালাগাল না করে চোখে খেজুরের কাঁটার খোঁচার মতো শুধুু সত্যটা মনে করিয়ে দিলাম। বললাম, ওইযে মনে নেই, পুরনো কোয়েল নতুন একটাকে জখম করার পর জহীর সেটা নিচে নিয়ে গিয়ে জবাই করে আনলো?
আমার ওই খোঁচার কাঁটা লেখার পর আবীর পলকা একটু ঝরা পালকের মতো, তাও পাখির নয়, ফড়িংয়ের পালকের মতো শুধু লিখলো, ‘ও!’
তারপর আমাকে অবিশ^াসী ঠাওরানোর জন্য মনে মনে চেঁচিয়ে ওকে দিনভর গালাগালি দিলাম। বললাম, মানুষের বাচ্চা…, তোরা নিজেরাও শান্তিতে থাকবি না, আর অন্যরা কেউ নিজের মতো করে একটু শান্তি বুনে পুলওভারের মতো তাতে মুড়ে থাকবে, তাতেও হেঁচকা টান দিবি!
আদতে তোদের অই বুড়োর মতো অন্যের গোসলের পানি চাপার দায় পুরণ করতে করতে মরণ হোক! পাখি-পশুর মতো অত উঁচু মার্গের স্বাধীনতা ভোগের কৌশল তোরা কখনোই আয়ত্ত¡ করতে পারবি না! অথচ দেখ, বাজপাখির দীর্ঘজীবি হওয়ার কৌশল দেখ! মানুষ এখন বাজপাখির জীবন যাপনের ধরণ লিখে গলায় ঝুলিয়ে রাখছে, তাতেও যদি সে তার থেকে কিছু বর পায়! অথচ মানুষের থেকে পশু-পখির শেখার এবং পাওয়ার কিচ্ছুটি নেই। অথচ পশু-পাখির থেকে মানুষের শেখার বিস্তর বিষয় আছে!
তাই ‘মানুষের বাচ্চা’র থেকে নিচু গালাগাল তখন আর আমার মাথায় একটিও আসেনি!
দীলতাজ রহমান
মানবতা এবং পাখবতার রজ্জু …
অস্ট্রেলিয়া থাকাকালীন একদিন দেখলাম আবীর একটা তেলচিটে প্লেটে কোয়েলের তিনটে ডিমের ছবি নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছে। ডিম দেখার আগেই দেখলাম, আমার দীর্ঘ চেনা সে প্লেটের চল্টাওঠা দাগ, আমার বাড়ির জানালা, দরজা, বারান্দার গ্রিল। আর গ্রিলের জন্য ছবিতে আকাশ-টুকরোকেও মনে হচ্ছিলো, আমার বড় চেনা এক পরিসর!
আমি কমেন্ট বক্সে লিখলাম, এমনিতে বাড়ি কাজের লোক নেই, তার ওপর আবার এই আপদ কে জোটালো?
উত্তরে আবীর লিখলো, ‘আমি কিনেছি, আমিই পুষবো!’
আবীরের উত্তরটা মুখ ফসকে যে কাউকে যা তা বলা স্বভাবের রূঢ় আমাকে কিছুটা নমনীয় করলো। ভাবলাম, কোনো কিছু পুষলে মানুষের অন্তর তৃপ্ত হয়। সবরকম বোধের উন্মেষ ঘটে। পোষাপুষি সেই অর্থে ঠিক আছে। আবীর আমার ছোটবোন শারমিন সুলতানা রীনার পুত্র। সে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সায়েন্স পড়ে।
আবীরদের বাসায় আবীরের বড়বোন বাঁধনের বিড়াল পোষার অস্বাভাবিক নেশা। নিজের টাকায় খাবার কিনে দাঁড়িয়ে থেকে রাস্তার কুকুরদেরও খাইয়ে আসে।
ভাগ্যিস বাসাটা দোতলা। তাই বাসায় কোনো কুকুর এনে তুলতে পারেনি। তবে বিড়ালে তাদের বাসা ঠাসা বলে আমি নিজেই ও বাসার পথ মাড়াই না। আর আবীরও আমাদের বাসায় এসে থাকে বিড়ালের উৎপাত ছাড়া নির্বিঘেœ বসবাস করতে। সেই নির্বিঘœ অবস্থাকামীর দ্বারা যদি আমার নির্বিঘœ অবস্থায় বিঘœ ঘটে, বাড়ির অভিভাবক হিসেবে যত দূরেই থাকি না কেন, একটু শঙ্কা তো মনে বাজেই!
যথাসময়ে দেশে ফিরে, ঘরে ঢুকেই যে শব্দ শুনি শুনি, তা কোনোভাবেই ক‚জন নয়, রীতিমতো একলার চেঁচামেচি! বললাম, চেঁচানোর শব্দ আসে কোত্থেকে? বাসার কর্ত্রী চাকরিজীবি আমার ছোটকন্যা ফারজানা রহমান। তিনি বললেন, ‘আবীরের কেনা দুটি কোয়েল থেকে ক’দিন আগে একটা মরে গেছে। ওটা মরার আগে কোনো চেঁচামেচি ছিলো না। একটা মরার পর আরেকটা এইভাবে চেঁচাচ্ছে!’
কন্যার উত্তর শুনে মনে মনে ভাবলাম, এমন অবস্থায় মানুষ চেঁচালে যারা দোষ দেয়, তাদের সব বাড়ি একবার করে এই পাখিকে পাঠানো উচিত। কারণ প্রকৃতির শিক্ষাই হলো আসল শিক্ষা। এর বাইরের শিক্ষা আরোপিত এবং অসম্পূর্ণ শিক্ষা!
একবার ফেনীর নতুন বাড়িতে ক’টা দেশি মোরগ-মুরগির সমাগম ঘটাতে চাইলাম। এ-বাড়ি ও-বাড়ি খবর দিয়ে ক’টা সুস্থ মুরগি জোগাড় করতে পারলাম বটে। কিন্তু তাদের বিস্তার লাভের জন্য একটিও বীর্যবান মোরগ আর পাই না। শেষে পালে কয়েকটা মোরগ আছে চেনা এমন একজনকে লোক মারফত ডেকে এনে, সুগন্ধি জর্দ্দায় ডবল খিলি পান খাইয়ে, বাকি সে জর্দ্দার কৌটাসমেৎ হাতে তিনগুণ দাম ধরিয়ে দিয়ে বললাম, তোমাদের বাড়িতে মোরগ আছে জানি। একটি মোরগ পাঠিয়ে দিও।
মোরগ বিক্রি করলে ধারেকাছের পড়শির উপকার হবে, তাই হৃদয়ের ওপর এত বড় ফাঁড়া নিয়ে সে মোরগ বিক্রিতে আগ্রহী ছিলো না। কিন্তু হাতে তিনগুণ দাম কড়কড়ে নোটটা ফেরতও দিতে ইচ্ছে করলো না। এমন দশার ভেতর মোরগ একটা এনে দিলো বটে। কিন্তু সে মোরগ আমার নানান বয়সী একপাল মুরগি পরিবেষ্টিত থেকেও, একেবারে ধারেকাছে কোনো বাড়ি নতুন বাড়িতে নেই, তবু দূরের প্রতিবেশীর কোনো মুরগির কুনকুন একটু ডাক শুনতে পেলে, ককক্ক ককক্ক ক করতে করতে দৌড়ে চলে যায়। যেতে যেতে গ্রীবার পেখমে যে ভাবখানা তার ফোটে, যেন ভীষণ মহৎ উদ্দেশ্যে যাত্রা করছেন তিনি! মনেপ্রাণে তীব্রপণ, যেন আমি আসছি তোমাদের সব যাতনা বধে …।
বাড়ির মুরগিগুলো যেমন দানা খুঁটে খাচ্ছিলো, তারা তেমনি খেতে থাকে! কোনোটাই তাদের সে সবেধন একমাত্র নীলমনি মোরগের পথ আটকায় না। পিছনে পিছনে কম বয়সী দুই-একটা বোহেমিয়ান সে পতির সাথে বিহারেও যায় না!
অথচ মনুষ্য-আচারের বৈপরীত্য, মোরগের এসব অনাচার চোখে পড়ে অধিকারবোধের মতো প্রবল মর্মজ¦ালাটি আমার একলার প্রাণে ভীষণ তড়পাতে থাকে। আমি আমার চৌকশ সহকারিণী মমতাজকে ডেকে বলি, বিধাতা পুরুষ তাহলে নারীর ভেতর কেন এতো ঈর্ষা দিয়েছেন? স্বামী বা প্রেমিকপুরুষের মনোযোগ, ভালবাসা, যৌনক্ষমতা এবং তার সহায়-সম্পত্তি, স-ব, সব তার স্ত্রী বা প্রেমিকা নিজের সুরক্ষায় কেন রাখতে চায়!
কালে কালে নারী-পুরুষ উভয়েরই সম্পর্ক এবং জীবন বেদম ভারাক্রান্ত এই এমন একটি বিষয়ের অধিকারের চর্চা নিয়ে, যা শতবার দলিল করিয়ে নিয়েও নিশ্চিত থাকার উপায় নেই! তবু শুধু একে একটা ঘেরাটোপে বাঁধতে এ নিয়ে কতো হাদিস-কালাম, ধর্ম ও আইনের শক্ত শক্ত শর্ত প্রয়োগ!
প্রাণীজগতের এইসব কাÐ দেখেশুনে আমার তো ইচ্ছে করছে, জোর গলায় বলি, এই মোরগের প্রবণতা দিয়েই তো বিধাতা পুরুষমানুষ গড়েছেন। তাহলে আইনকানুন সেই ধাতে ফেলে, শর্তগুলো সেরকম আরো খোলাসা হতে পারতো। আর নারীগুলোকে বিধাতা কেন শুধুই মুরগির মেজাজেই বানাতে পারলেন না! যাদের শেয়াল-বেঁজি, কাক-চিলের মতো ভয়ঙ্কর প্রতিপক্ষের সাথে লড়াইয়ের তাগদ থাকলেও ঘরের পুরুষকে আটকানোর কোনো প্রবণতা, কোনো আগ্রহ-ভালবাসা থাকবে না!
পুরুষকূলকে কেবল তাদের ইচ্ছে মাফিক তারা সন্তানের বীজদাতা করে রাখা ছাড়াও হেলায়ফেলায় মাঠের ফসল তোলার চাষিগিরি, চাক ভেঙে মধু আনার মৌয়ালগিরির মতো আরো এমনি সব কাজের জন্য যদি পোষ্য মানে বশ করে রাখতো, সেটাই বেশ হতো। নারী তখন বনের অন্যান্য বন্য পশু ঘোড়া, গাধা, হাতি, জিরাফ, হরিণ ছাড়াও বাঘের দিকেও নজর দিতো ঘরে এনে পুষতে।
কারণ রাখাল সমূহ’র ভরণ- পোষণের মূল্য উসুলের চিন্তাও তখন নারীর মাথায় চলে আসতো নিশ্চয়! নিশ্চয় তখন রেওয়াজটাও ওনরকম হতো, যার দখলে যত বেশি পুরুষ থাকতো, সে নারী ততো বেশি সম্মানীয়, ক্ষমতাধারি!
এমন প্রথা-ই চালু থাকলে, ঘরের বাইরে থেকে টানাপাখা টানতে টানতে পুরুষ তখন বুঝতো স্ত্রী’র ওই দাবড়ে ধরে ভালবাসা, যতœ-আত্মি কী রক্ষাকবচ! এমন কি তার ওই আত্মঘাতী অধিকারবোধও তখন কী মধুর!
আসলে সৃষ্টি এবং রক্ষার প্রধান কাজটি যে নারীই করে, তা বাঘের দিকে তাকিয়ে নারীর পক্ষেই রায় দিন বিজ্ঞ বিচারক মÐলি!
কেন যে ঈশ^র স্বামীর ওই ঠুনকো, পতনজাত বীর্য রক্ষায় জীবন বিপন্ন করা অমন শাঁখের করাতের মতো করে দামি ঈর্ষাটুকু গুঁজে দিলেন সুজলা-সুফলা নারীর কোমল প্রাণের ভেতর, যাতে করে পৃথিবীর রূপই পাল্টে গেলো এবং যার মাত্রাতিরিক্ত প্রয়োগে সমাজও তাকে কখনো খল ঠাওরায়।
তাহলে শুরু থেকে নারীকে মানবতাবোধের চেয়ে পাখবতাবোধটা বেশি শেখাতে পারলে, পুরুষের সাথে নারীর সম্পর্কের আটোঁসাঁটোভাবটা কমে আসবে। তাতে রক্ষা পাবে অনেক সংসার। কোনো শিশুকে আর চোখের সামনে পোহাতে হবে না, মা-বাবার সম্পর্ক ভাঙার মর্মান্তিক যাতনা!
ঘরে বিপতœীক কোয়েলটি নিয়ে এইসব ভাবনার ভেতরে একদিন আজিজ সুপার মার্কেট যাওয়ার দরকার হলো। ড্রাইভার বাংলামোটরের জ্যাম এড়াতে কাঁটাবন হয়ে ঘুরে গেলো। এতে করে রাস্তার পাশে অপ্রত্যাশিতভাবে পাখির দোকান দেখে ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বললাম।
কয়েক দোকানে খুঁজেও কোয়েল পেলাম না। শেষে এক দোকানে আধাখাস্তা তিনটে পেলাম। আমার দরকার একটি নারী কোয়েলের। ও, আমারই বা দরকার কোথায়? দরকার তো ওই মাথা গরম পুরুষ কোয়েলটার, যে আস্ত পৃথিবীর প্রতি মারমুখী হয়ে আছে! দোকানী নারী কোয়েল বলে যেটা দিতে চাইলো, আমার সন্দেহ যাচ্ছিলো না কোয়েল-নারীর আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য না জানা থাকায়। তাই দুটো একসাথে নিলাম।
সদ্য কেনা কোয়েল দু’টোই মুমুর্ষ ছিলো। তবু অনন্যোপায় হয়ে কেনা যেহেতু! দুপুর পেরিয়ে বাসায় এনে কোয়েল দুটোকে খাঁচার ভেতর ঢোকাতেই পুরনো কোয়েলটা মুহুর্মুহু একটা ছেড়ে আরেকটা যেভাবে ধরছে, তাতে আমি তো আমি, যে কোনো কারো তাজ্জব না বনে উপায় ছিলো না!
আবারও ভাবতে লাগলাম, তাহলে সেই তো মানুষেরই আর দোষ কী!
প্রায় বিশ বছর আগে আমারই এক প্রকৌশলী বান্ধবী ফেলে আসা দিনের কথা বলতে বলতে কখন তার পুরো ঝাঁপি খুলে গেছে, সে তা টেরই পায়নি! না হলে এমন করে আর ক’জন বলতে পারে, ‘মা মারা গেলে ক’দিন না যেতে বাবা আবার বিয়ে করতে চাইলেন। আমাদের চার ভাইবোনেরই তখন বিয়ে হয়ে গেছে। তাই আমরা ভাইবোনেরা সবাই মিলে মানা করলাম। কেউ কেউ বললামও, আপনি মারা গেলে আমাদের মা কি এরকম কথা বলতে পারতেন? ভাইয়ের বৌয়েরাও বাবাকে বললো, আব্বা আপনার কোনো অযতœ হবে না…।
কিস্তু আব্বা তবু বিয়ে তো করলেনই, তাও কোনখান থেকে এক কম বয়সী মেয়েকে বিয়ে করে আনলেন। তারপর আব্বার সকালে গোসল করার পানি আমরাই কল থেকে চেপে বাথরুমে পৌঁছে দিতাম। কিন্তু আব্বা সে বেটির গোসলের পানি চাপতে চাপতে বুকে ব্যথায় অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আব্বা অসুস্থ হলে আমরা সবাই হাসপাতালে আব্বাকে নিয়ে ব্যস্ত। আর খালি বাড়ি ফেলে বেটি ভেগে গেছে। ভয়ে। ভেবেছিলো, আমরা হয়ত তাকে দোষারোপ করবো, মারবো!
আব্বা হাসপাতাল থেকে আর ফিরতে পারেননি। তারপর আব্বার কুলখানির আগেই ভাইয়েরা সে বেটিকে খুঁজে কাবিনের টাকা শোধ করে আসছে, আব্বাকে দায়মুক্ত করতে!’
পাখির কাÐকারখানা দেখে ক’দিনধরে এই গল্পটিও আমার মন থেকে মাথায় উঠে কাকের মতো ঠোকরাচ্ছে। এখন ভাবছি, এই কাহিনীর সবই ঠিক ছিলো, খালি যার গোসলের পানি তাকে চেপে নিতে বললেই হতো! আর বাপের কাবিনের টাকা ছেলেমেয়েদের হাতে শোধ হওয়াটাও একটু কেমন যেন ঠেকে। তাই মানুষ বোধহয় এইখানেই এসে ঠেকে গেছে! পাখি হতে তার এখানেই বড় বাঁধা!
শেষ বয়সে আরেকটি বিয়ে করলে, পিতার ¯েœহ-মমতা ভাগ হওয়ার সাথে, জন্ম নেয়া নতুন শরিকের হাতে চলে যায় সম্পত্তির সমান ভাগও।
শেষে এই মানবিক আর পাখবিক দুইরকমের দুইটি বিষয় রজ্জুর মতো আমার সমস্ত চৈতন্য এক করে একটানা পাকাতে লাগলো।
সেদিন নতুন পাখি খাঁচায় ঢোকানোর পর, বাকি সেটুকু বেলা আর চেঁচামেচি শোনা গেলো না। কিন্তু রাত একপ্রস্থ পার হতেই আবার একটার প্রাণঘাতী চিৎকার! চিৎকারের কারণ জানতে চাইলে, মাত্র একদিন আগে কিশোরগঞ্জের কোনো এক গ্রাম থেকে কাজের জন্য আসা ষাটোর্ধ্ব মহিলা, যাকে ইতোমধ্যে খালা বলে ডাকতে শুরু করেছি, সে-ই বললো, ‘এইহানো ব্যাডা দুইডা, আর মাইয়া একটা! এক মাইয়ারে লইয়া, দুই ব্যাডার খুনাখুনি…!’
আমি সে মৃত্তিকাঘনিষ্ঠ জীবনের অধিকারিনী খালাকে সাক্ষী মেনে বললাম, কিন্তু তুমিও তো দেখলে, আনার সাথে সাথে পুরান কোয়েল যা আচরণ করলো, তাতে তো মনে হলো, নতুন দুটোই মেয়ে!
খালা বললো, ‘তহন কি আর ব্যাডা চোউখ দিয়া দ্যাকছে? এহন যহন মাথার আগুন কমছে, এহন দিশা বাইরাইছে!’
আমি বললাম, তাহলে ঠ্যাকায় পড়লে পাখিও সমকামী হয় বলছো?
সমকামী শব্দটি আগে না শুনলেও খালা ফেরে পড়ে বুঝে গেছে। শেষে আমার দিকে তাকিয়ে সরুচোখে বললো, ‘দ্যাকলা তো নিজের চোউখ্খে!’
এরপর আর সময় ক্ষেপণ চলে না। আমি খাঁচার কাছে গিয়ে দেখলাম, নতুন দুটোর একটার মাথা বেয়ে রক্ত পড়ছে এবং যন্ত্রণায় সে মাথা তার ঘাড়ের ভেতর সেঁধিয়ে আছে। বুঝলাম ঘায়েল হওয়াটা নতুন পুরুষ! যদিও এই কতল হওয়া মাথা নিয়ে নারীঘটিত বিষয়ে এর পুরনোটার সাথে প্রতিদ্ব›িদ্বতায় যাওয়ার সাহস-ক্ষমতা কোনোটাই আর হবে না, তবু জহীরকে ডেকে বললাম, এটাকে জবাই করে আনো।
জহীর সেটা জবাই করে চামড়া ছিলে, একটুকরো কাগজে মুড়ে ঢিল ছোঁড়ার মতো করে ডিপফ্রিজে ছুঁড়ে মারলো। আর খালা ছুটে এসে তু তু করে বললো, ‘জবাই না কইরা ছাইড়া দিলে কি অইলো অইলে?’
আমি বললাম, মায়া লাগতেছে?
খালা উত্তর দিলো, ‘অয়ও!’
বললাম, মুরগি খাও না? গরু? হরিণ? মোষ? তখন মায়া লাগে না? এটাও তো টাকা দিয়া কিনছি! তাই একসময় ভেজে খেয়ে ফেলবোনে!
খালার চোখ ভিজে উঠলেও এতোটা ভয় পেতাম না! কিন্তু দাবানল শেষের বন আমি দেখেছি। পুড়ে কয়লা হওয়া গাছ থেকেও ডাল জন্মে। ভয়ঙ্কর সে দৃশ্য! তাই আপাতত সেখান থেকে সরে গিয়ে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঠেকালাম।
এরপর এক খাঁচায় সুখে-শান্তিতে বাকি কোয়েলদ্বয় বসবাস করলেও আবীরের তাতে আর আগের মতো আগ্রহ টের পেলাম না। জীব-জন্তু, পশু-পাখি পুষতে আমারও ভালো লাগে। কিন্তু তা মনে মনে। কারণ অত বাহুল্য সময় আমার জীবনে কোনোকালে ছিলো না, যে, নিরালায় বসে পাখির অধিক নিজের সাথেও দুটো অনিবার্য কথা বলি!
এই ক’দিন আগে আবীরকে বললাম, একমাস না যেতেই খালা তো তার নাতিপুতির টানে চলে গেছে। তুমি যেহেতু কিনেছো, এখন পাখিকে ঠিকভাবে খাবার দেওয়া, মাঝে মাঝে তোমার সাথে বাথরুমে নিয়ে তাদের গোসল করানো এবং সাধারণভাবে পরিষ্কার করার দায়-দায়িত্ব তোমার। না হলে কিন্তু গোনাহ হবে। পশু-পাখি পুষলে তা দরদ দিয়ে পুষতে হয়। আর গোসল মানে তো, তুমি নিজের গোসলের সময় খাঁচাসহ ওদেরকে তোমার পায়ের কাছে রেখে দিলে শাওয়ারের ছিঁটে আসা পানিতেই ওদের গোসল হয়ে যায়…।
আবীর গলা ঝাড়া দিয়ে বললো, ‘এবার তো আপনি কিনছেন! আমি আগেরবার কিনছিলাম!’
আমি বললাম, ওম্মা, তাই নাকি? তোমার কেনা পাখি একটা মারা যাওয়াতে আরেকটার চিৎকারে টিকতে না পেরে বিরহী সে পাখির প্রতি মায়া, আর তোমাকে সম্মান করেই না এতো হ্যাপা করে আমি কিনলাম, আর তাতেই আমার দোষ?
আবীর বললো, ‘তয় কি? আমি কি আবার কিনতে গেছিলাম নাকি?’ বুঝলাম, তার মোহ টুটগিয়া! তবু খাবার ফুরিয়েছে দেখে, সে দু’দিন আগে পান্থপথ বাসা থেকে হেঁটে হেঁটে যাওয়া-আসা করে কাঁটাবন থেকে পাখিদের খাবার এনেছে। কিন্তু খাবারই তো শেষ কথা নয়! পাখি বেচারিদের পুরোপুরি যতœ হচ্ছে না দেখে আমার মনটা খুব কাতরাচ্ছিলো। কী করি, কাকে দিই! যাকে তাকে তো পোষা পাখি দিলে হবে না। দিতে হবে যে এগুলোকে ভালোবাসবে। আবার যাকে দেবো সে হতে হবে আমাদের ভালোবাসার মানুষ!
একটি চ্যানেলের নামকরা সাংবাদিক, আদিত্য শাহীন ও ‘পারি’ পত্রিকার সম্পাদক লাইলা খালেদার বৃক্ষপ্রেম দেখে, আদিত্য’র স্ত্রী লাইলাকেই বললাম, আমার একজোড়া কোয়েল আছে। তোকে দিতে চাই।
সে বললো, ‘দেন আপা, খাবার কিনে নিচে কেয়ারটেকারদের কাছে রাখবো …। ’ লাইলার কথায় মনটাতে একটু মোচড় দিয়ে উঠলো। মনে মনে ভাবলাম, এত কম যে ভালবাসবে, অথবা বাসবেই না, তাকে এতদিনের পোষা পাখি সমর্পণ করা যাবে না! লাইলাকে দিলে নতুন কিনে দেওয়া যায়।
পথের ভেতর আবীরের মা’র কথা মনে হলো। তিনি আবার ইদানীং ছড়া লিখে বেশ খ্যাতি পেয়েছেন। সেই সুবাদে ফোনও ব্যস্ত থাকে। মানে বন্ধু-বান্ধব বেড়ে গেছে। তবু তাকে ফোন দিয়ে সাথে সাথে পেয়ে গেলাম এবং বললাম, আবীরের পাখি জোড়া তোমরা রাখো। ছড়াসাহিত্যিক তিনি বললেন, ‘আমাদের ঘরভরা বিড়াল। সমবেত হয়ে তারা খাঁচার শিক ভেঙে একলহমায় ও দুটোকে কাড়াকাড়ি করে খেয়ে ফেলবে!’
সব শেষে মন এক ভিন্নমুখ খুঁজে পেলো, কোয়েল গ্রহীতা হিসাবে যে হবে সেরা উপযুক্ত। কবি অঞ্জনা সাহার তিন বছরের পৌত্রীর মুখ মনে পড়লো। সাথে সাথে দ্বিতীয়, তৃতীয় মনও, মানে একটা মানুষের যে ক’টা মন থাকে তার সবই এসে এইমুখের পক্ষে সায় দিলো।
আবীরকে ডেকে বোঝালাম, পাখি পোষা দোষের নয়, যদি তুমি তাকে ভালোবাসো। পাখির কাছ থেকে আকাশ ছিন্ন করে খাঁচায় ভরেছো, ঠিক আছে। কিন্তু তাকে ভালোবাসা দিয়ে তো তা পুষিয়ে দিতে হবে! বন্দিত্বেও যে কেউ কিছুটা সার্থকতা খুঁজে পেতে পারে, যদি তার মনে হয়, শুধু ভালোবাসতেই কেউ আমাকে বন্দি করেছে। কিন্তু ভালো না বেসে অবারিত স্বাধীনতা থেকে যে কাউকে বন্দি রাখলে তো নিজেরও একটি যাতনা তৈরি হয়। না কি?
আবীর বললো, ‘ঠিক!’
আমি আবীরের অনুমতি পেয়ে কবি অঞ্জনা সাহাকে বললাম, আমি যে কোনো সময়ে তোমার বাসায় একটি জিনিস দিতে আসবো। এই প্রতিশ্রæতির পর সময়ের অভাবে কবিকে দু’দিন অপেক্ষায় রাখতে হলো। তারপর যখন গেলাম, পৌত্রী অদ্বিতীয়া রাই দরজার কাছেই ছিলো। আগে খাঁচাটা নজরে পড়তেই ওইটুকু রাই, সেও বুঝতে পারলো ভেতরে পাখি আছে!
তারপর তার বাড়ানো দু’হাতে গ্রহণের ভেতর দিয়ে আমার পাখি সমর্পণের কাজটি মধুরভাবে সম্পন্ন হলো। বুঝিয়ে দেয়া হলো পাখির বাকি খাবারও। যা সে এ বাড়িতে থাকলে আরো ক’দিন খেতো।
এদিকে চাকরিজীবি মেয়ে-জামাই দুজন দু’দিন রান্নাঘরের বারান্দায় গিয়ে কোয়েলদ্বয়কে দেখতে না পেয়ে, আলাদাভাবে একই কায়দায় অবাক চোখে জানতে চাইলো, ‘পাখি গেলো কই?’ আমি দু’জনকে একইরকম করে উত্তর দিলাম, কবি অঞ্জনা সাহার পৌত্রীকে গছিয়েছি!
দুজনেই সেই একইভাবে অনিবার্য আরেকটি প্রশ্ন করলো, ‘আবীর কিছু বলেনি?’
আমি সেই একইরকম করে দ্বিতীয়বার আরেকটি যে উত্তর দিলাম, বললাম, আবীরকে বুঝিয়েছি, ভালোবাসার বিনিময়ে কাউকে বন্দি রাখা যায়। কিন্তু অবহেলা করে তো বন্দি রাখার দরকার নেই! কোয়েল দু’টিকে তাকেই দিই, যে ওদের ভালোবাসবে…!
কথা শেষ না হতেই দু’জনেই তাদের শেষের প্রশ্নটি ঝেড়ে দিয়েছে, ‘আবীর কী বললো?’ তিন নম্বর প্রশ্নটিও সেই আমার একইরকম। বলি, ও তো এমনভাবে ‘দ্যান’ বললো, যে দিতে পেরে বাঁচলো বলে মনে হলো।
আর যেটুকু শোনার জন্য কেউ-ই অপেক্ষা করে না, তা হলো, যে কাউকে প্রতিদানহীন একটানা ভলোবেসে যাওয়া সোজা কথা নয়। সে পাখিই হোক, গাছ কিংবা মানুষ!
কোয়েল অবশ্য ক’দিন বাদ দিয়ে আবার একটানা ক’দিন একটি করে ডিম্ব দিতো। কিন্তু নর্থ সাউথে লাস্ট ইয়ারে পড়া একজন ছাত্রের প্রতিদিন অনেকখানি করে অভিনিবেশ পেতে মাঝে মাঝের সে ডিম্ব আর প্রতিদান হিসেবে কতোটুকু!
গল্পটি এখানেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু আবীর আজ মেসেজবক্সে লিখে রেখেছে, ‘একটা জবাই করা কোয়েল দেখলাম ফ্রিজে! আপনি কি কোয়েল দুটো আসলে কাউকে দিয়েছেন, না কি, না দিয়েই দেওয়ার মিথ্যে গল্প লিখেছেন?’
গল্পটি লিখে খাবার টেবিলে সবার সাথে তা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। আবীর তা ভোলেনি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ওর ওই ক্ষুদে বার্তা দেখে মাথায় রক্ত চড়ে গেলো আমার। আমি তার খালা, মানে মায়ের বড় বোন! তাও তার মায়ের পিঠাপিঠি বড় বোন নয়, মাঝখানে আরো দু’জন আছে! তাই ভাবছি, সম্পর্কের এই বিশাল ভার আর বয়সের দুস্তর ব্যবধান অমান্য করে সে আমাকে এমন কথা লিখতে পারলো কি করে?
তড়বড় করে গালাগাল না করে চোখে খেজুরের কাঁটার খোঁচার মতো শুধুু সত্যটা মনে করিয়ে দিলাম। বললাম, ওইযে মনে নেই, পুরনো কোয়েল নতুন একটাকে জখম করার পর জহীর সেটা নিচে নিয়ে গিয়ে জবাই করে আনলো?
আমার ওই খোঁচার কাঁটা লেখার পর আবীর পলকা একটু ঝরা পালকের মতো, তাও পাখির নয়, ফড়িংয়ের পালকের মতো শুধু লিখলো, ‘ও!’
তারপর আমাকে অবিশ^াসী ঠাওরানোর জন্য মনে মনে চেঁচিয়ে ওকে দিনভর গালাগালি দিলাম। বললাম, মানুষের বাচ্চা…, তোরা নিজেরাও শান্তিতে থাকবি না, আর অন্যরা কেউ নিজের মতো করে একটু শান্তি বুনে পুলওভারের মতো তাতে মুড়ে থাকবে, তাতেও হেঁচকা টান দিবি!
আদতে তোদের অই বুড়োর মতো অন্যের গোসলের পানি চাপার দায় পুরণ করতে করতে মরণ হোক! পাখি-পশুর মতো অত উঁচু মার্গের স্বাধীনতা ভোগের কৌশল তোরা কখনোই আয়ত্ত¡ করতে পারবি না! অথচ দেখ, বাজপাখির দীর্ঘজীবি হওয়ার কৌশল দেখ! মানুষ এখন বাজপাখির জীবন যাপনের ধরণ লিখে গলায় ঝুলিয়ে রাখছে, তাতেও যদি সে তার থেকে কিছু বর পায়! অথচ মানুষের থেকে পশু-পখির শেখার এবং পাওয়ার কিচ্ছুটি নেই। অথচ পশু-পাখির থেকে মানুষের শেখার বিস্তর বিষয় আছে!
তাই ‘মানুষের বাচ্চা’র থেকে নিচু গালাগাল তখন আর আমার মাথায় একটিও আসেনি!