দূর আকাশে দূর মৃত্তিকায় ।। ভ্রমণ স্মৃতি গদ্য – ১
সুমায়েল মুহাম্মদ মল্লিক
দারুচিনি দ্বীপে
দ্বারুচিনি দ্বীপ এর দেশ বলে পরিচিত ইন্দোনেশিয়া। কৈশরে বিশিষ্ট সাংবাদিক সানাউল্লাহ নূরী লিখিত দারুচিনি দ্বীপের দেশ পড়েছিলাম। তখন থেকেই ইন্দোনেশিয়ার প্রতি বিশেষ আগ্রহ। সুমাত্রা, জাভা, মাঙ্গুরা সহ হাজারো দ্বীপ নিয়ে গঠিত সাড়ে সাত লক্ষ বর্গ কিলোমিটারের ভূমি নিয়ে এই ইন্দোনেশিয়া। বিশ্বে সর্বোচ্চ মুসলিম জনসংখ্যার দেশ ইন্দোনেশিয়া। ‘রাবাত থেকে জাকার্তা’ কথাটি তখন প্রায়ই উচ্চারিত হতো। ১৯৮০ সালে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সূহার্তো ঢাকা সফর করেছিলেন। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানও জাকার্তা সফর করেছিলেন। বাংলাদেশ ও ইন্দোনেশিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রথম থেকেই ভাল।
ঢাকা-জাকার্তা ডাইরেক্ট বিমান ফ্লাইট না থাকার কারনে সিঙ্গাপুর, মালয়শিয়া বা ব্যাংকক কে ট্রানজিট হিসাবে নেওয়া হয়। ২০০৭ সালের এপ্রিল এর শেষ সপ্তাহে জাকার্তা সফর করি। ঢাকা-সিঙ্গাপুর-জাকার্তা রুটকে বেছে নিলাম। সফর সঙ্গী হিসাবে ছিল ফারিহা টেক্সটাইলের জিএম ইঞ্জিনিয়ার ইকবাল হোসেন।
ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপ সারা বিশ্বের টুরিস্টদের অন্যতম আকর্ষণ। আশির দশকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান বালি দ্বীপে এসে রাত যাপন করেছিলেন। তখন ভয়েস অফ আমেরিকা (VOA) এর সংবাদ বুলেটিনে বালী দ্বীপের নাম শুনি। সংবাদ পাঠক সরকার কবির উদ্দিন এর ভাষায় ‘রিগ্যান এখন বালিতে’। কথাটি আজো কানে ভাসছে। যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিগ্যান কিংবা জিমি কার্টার ইন্দোনেশিয়া সফর করতেন, তখন কিন্তু তারা ভারত বা পাকিস্তানে কখনো সরকারী সফরে আসতেন না।
আসিয়ান ভুক্ত দেশ ইন্দোনেশিয়া এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক স্বাধীনতা না থাকায় অর্থনীতি এখন ভঙ্গুর। নেদারল্যান্ড থেকে স্বাধীন হওয়ার পর ডঃ সুর্কনো আজীবন দেশ শাসন করেছেন। সুর্কনো এর পরে শাসন বার পরিচালনার দ্বায়িত্ব এসে পড়ে সুহার্তো এর উপর। একনায়ক সুহার্তো এর শাসনের শেষভাগ ছিল বড়ই কঠিন ও দুঃখজনক। রক্তপাত-দাঙ্গা-হাঙ্গামা-বিক্ষোভের টানা এক মাসের মাথায় ইন্দোনেশিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী ক্লান্ত হয়ে পড়ে। অবশেষে গণ আন্দোলনের মুখে তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। ১৯৮৬-৮৭ সারের দিকে প্রেসিডেন্ট এরশাদও জাকার্তা সফর করেছিলেন। জাকার্তায় বিমান তৈরীর কারখানাও পরিদর্শন করেন। সেই সময় ঢাকায় এক সেমিনারে এরশাদ বলেছিলেন- ‘ইন্দোনেশিয়া বিমান তৈরী করছে আর আমাদের দেশের অবস্থা কোথায়।
সিঙ্গাপুর, মালয়শিয়া কিংবা ব্যাংকক এর মতো জাকার্তা বিমান বন্দর ব্যস্ত নয়। বিমান বন্দরটি প্রাচীন ঐতিহ্যের কীর্তি বহন করছে। রাজধানী জাকার্তা খুবই যানজট পূর্ণ। গাড়ী পার্কিং মানেই ঝামেলা। পার্কিং করতে ১০ থেকে ১৫ মিনিট লাগে। এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যেতে টোল দিতে হয়। গাড়ীর ডেস্কটপে অনেক ভাংতি টাকা রাখতে হয়।
বড় ছোট মার্কেটের সমাহার জাকার্তা। ব্যবসা-বাণিজ্যে চাইনিজ বংশদভূত ইন্দোনেশিয়ানদের আধিপত্য দেখা যায়। মুদ্রাস্ফীতির ভারে জর্জরিত দেশটি। বস্ত্রশিল্পে এক সময়ে শক্তিশালী অবস্থানে ছিল ইন্দোনেশিয়ার। বিশেষ করে স্পিনিং মিল রয়েছে দেশটিতে। হাই কোয়ালিটি সম্পন্ন ওভেন কাপড় তারা উৎপাদন করে। ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ হিসাবে ডাইস্ ও ক্যামিকেল প্লান্ট রয়েছে। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীগুলো আশীর দশকেই শাখা অফিস খুলেছে। মাকস্ এন্ড স্পেনসার, অ্যাডিডাস, নাইক, লি, ক্যারিফোর এর মতো বড় বড় কোম্পানীর শ্যোরুম দেখলাম মার্কেটগুলোতে। তুলনামূলক কাপড়ের দাম সস্তা।
রাজধানী থেকে কিছুটা দূরে ইন্ডাষ্ট্রিয়াল পার্ক। এই পার্কেই আছে বিভিন্ন শিল্প কারখানা। একটি ডাইস্ (রং) ফ্যাক্টরি পরিদর্শনে যাওয়ার পথে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। ছোট একটি হোটেল কিন্তু গুছানো। দুপুরে খাবার বেলা -১২টা থেকে ১ টার মধ্যে শেষ করতে হয়। ১ টার পর কোন কাষ্টমার নেই। অনুরোধ করার পর আমাদের জন্য খাবার সরবরাহ করল। সালাত তাদের প্রিয় আইটেম। মিঠা পানির ও সামুদ্রিক মাছ উভয়ই পাওয়া যায়। মুরগী-হাঁসের চামড়া শুকিয়ে ভেজে খাওয়া হয়। হাঁসের মাংস তাদের খুবই প্রিয়। ভাত সামান্য পরিমানে খায় ইন্দোনেশিয়ানরা। সেটা স্টিম রাইস। সবজি থাকে সাত-আট ধরনের।
টেক্সটাইল কেমিক্যালস্ কোম্পানী পি.টি. ছেন্টা ব্রাসিনডো আবাদি (ছিবিএ) এর ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মিস্টার টেডি টিও এই সফরে আমাদের গাইড ছিলেন। জাকার্তা অবস্থানকালীন পাঁচ দিনই আমরা টেডিকে পেয়েছি। ওনার বয়স ৫০ এর কাছাকাছি। কিন্তু কোন ক্লান্তি নেই। কাষ্টমার ডিলিংস্ কি, সেটা তার কাছ থেকে শিখতে ইচ্ছে করে। তিনি এককভাবে ছোট্ট একটি প্লান্ট থেকে বিশাল রপ্তানীমুখী ইউনিট গড়ে তোলেন।
মার্কেটিং লিয়াঁজো অফিস জাকার্তা’র ইন্টারকল প্লাজাতে। টেডি খ্রিস্টান কিন্তু তার অফিসের অধিকাংশ মুসলিম। জাকার্তার প্রথম দুই রাত হোটেল নভোটেল-এ অবস্থান করি। ২০০৬ সালে ব্যাংকক গিয়েছি। তখনও এই চেইন হোটেল নভোটেলে ছিলাম। শহরের প্রাণকেন্দ্রে এটার অবস্থান। শেষের দুই দিন সি-বিচ সংলগ্ন পাঁচ তারকা হোটেলে ছিলাম। একটি নির্দিষ্ট এলাকায় সাতটি পাঁচ তারকা হোটেল, কালচারাল সেন্টার, সিনেপ্লেস, ফিটনেস সেন্টার, ব্যায়ামাগার সহ সকল আধুনিক সুযোগ-সুবিধার ডিভাইস রয়েছে। হোটেল কক্ষ থেকে সমুদ্্েরর মনোরম দৃশ্য দেখা যায়। শত শত নৌকা সমুদ্রে ভাসছে। সমুদ্রের পানির ঢেউ খুব একটা বেশি নয়- বলা যায় শান্ত সমুদ্র।
ডাইস্টাফ কোম্পানী কালারিন্ডো পরিদর্শন করলাম একদিন। টুয়ান্ডি জাকারিয়া এই কোম্পানীর প্রডাক্শন ডাইরেক্টর। বিশাল ফ্যাক্টরী। শতাধিক রি- এক্টর চালু আছে। প্রতিদিন ২০০ টন ক্ষমতা সম্পন্ন ডাইস উৎপাদন করে। কালারিন্ডো এর মত ফ্যাক্টরী সারা ভারতে হাতে গোনা থাকতে পারে।
৪ মে ঢাকা আসার সময় সিঙ্গাপুর বিমান বন্দরে দেখা হলো রিজভী ভাই এর সাথে। উনি উইভিং-এ অভিজ্ঞ। ভিয়েতনাম সফর করে ঢাকা ফিরছেন। ভিয়েতনামের অর্থনৈতিক ও শিল্প ব্যবস্থার কথা বললেন। বস্ত্র শিল্পে উদীয়মান শক্তি ভিয়েতনাম। রাজধানীতে পাঁচ তারকা হোটেল তৈরির ধূম পড়ে গেছে। ব্যপক বিদেশী বিনিয়োগ আসার ফলে গত দশ বছরে হোচিমিন সিটি নতুন আঙ্গিকে রুপ নিয়েছে। স্পোকেন ইংলিশ এর কোচিং সেন্টার খুলেছে অজস্র। খোলা মেলা আলাপ হলো। ইকবালও আনন্দে অংশিদার হলো। ইকবাল ও আমি এয়ারপোর্টে স্লিমিং ইন্সট্রমেন্ট খুজছি। শরীরে ওজন ক্রমশ বাড়ছে। কমাতে হবে। দু’পরিবার থেকে চাপও আছে। তাই দু’জনেই স্লিমিং বেল্ট কিনলাম। আমাদের বেল্ট কেনার পর পরই আরও তিনটি বেল্ট বিক্রি হলো ঐ দোকানে। সেলস্ গার্ল আমাদেরকে লাকি পারসন বলে সম্বোধন করল।
বিমানে ওঠার সময় দেখা হলো মাজিম কর্পোরেশনের পরিচালক মামুন ভাই এর সাথে। ওনার মাকে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা শেষে ঢাকায় আনছেন একই ফ্লাইটে। সাথে ওনার বড় ভাইও আছেন। সিঙ্গাপুরে দীর্ঘদিন তার মাকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল।