কবিতা

নজরুল মোহাম্মদ

একগুচ্ছ কবিতা

[]পাখি জীবন কিংবা দীর্ঘশ্বাস

অবহেলায় এই সমাধি!জীর্ণতম সোনালি চোখের পারদে রেখেছে ক্ষমাহীন ভোর— প্রতিজ্ঞাপাশে পরাজিত মানুষের যে গ্লানির ভার,প্রাণের ভেতর যে বিশীর্ণ হাহাকার,জলের তরঙ্গে আঁকে আঘাতের দাগ!জাদুবলে মুছে যায়নি বিশ্রুত আলো,নিমীল ঢেউ,বেলোয়ারি চুম্বনে প্রগাঢ় ক্ষত— বিকীর্ণ বাতাসে নীলাভ জলে রাঙা রোদ উড়ে যায় প্রার্থনা গীতে!মানুষকে ভালোবাসতে গিয়ে অসহায় হয়ে যাই,দীর্ঘ আলোর ভেতর হয়ে যাই আশ্রয়হীন— ভুলের সময় থেকে উঠে আসে মোমের জীবন যে কষ্টে পোড়ে ছাপ রাখে বেদনার সিলমোহরে!

সূর্যের পলায়নমুখী আলো দণ্ডিত আসামির চোখে রাখে রাতের নিস্তব্ধতা— ইংগিতে করুণ,নিরীহ,নিরাশ্রয়;মাটির নিঃশব্দতম ডাকে প্রতিনিয়ত দেবে যায় জীবনের পা!অবিশ্বাসের চোখে রাতের গোপন জল খরস্রোতে কুড়ায় স্মৃতির নুড়ি নিরুৎকীর্ণ মাঠে— উতরালো হৃদয়ে রুয়ে যায় বেদনার বীজ ভেজা নীল ছায়ায় যেন জ্যামিতিক রেখায় মেলাতে চায় জীবনের উপপাদ্য জটিল সূত্রে!বুদ্বুদের এই কলরব ফেটে যাচ্ছে শিমুলের মতো মাতৃবুকে যে হাওয়ায় ছিটিয়ে দিচ্ছে কাঙ্খিত স্বপ্ন গভীর বিস্ময়ে— সময়ের অনিবার স্রোতে ভেসে আসে প্রেম সাহসিক নগরে!

যে সর্বনাশে বেহাত হয়ে গেলো মন সে নিরুত্তেজ অনুভব রক্তঝরা হৃদয়ে রাখে দহনের মনমরা ফুল— নিজের এই অবাধ্য মন চেনা দায় যেমন দুর্বোধ্য পাখির ভাষা তবু কান পাতি!পাখির গানে কী থাকে কান্নার সুর?জন্ম কিংবা মৃত্যুতে তারা-ও কী ভাষাহারা হয়?বিনিময়ের হিসেবে মানুষ মহাজন— চতুর অন্ধচোখে লুট করে সমস্ত লজ্জা;অগণন মৃত্যুর শোকে-ও হাসে অট্টহাসি!মানুষের পোশাক রেখে পাখি হতে চাই;ডানার প্রশস্ততায় রাখতে চাই মুক্তির স্বাদ— অথচ মানুষ নামের অমানুষ বুকে করেছে তাক স্বার্থের বন্দুক!

_________________________

[] ভাগ্যনির্ধারক মুদ্রা 

মিহি-কান্নায় প্রস্ফুটিত হচ্ছে বিরহগন্ধা রাত— নিঃশব্দতম বিলাপে বেজে উঠছে রোদনমুখর ভেজা সময় যে হাওয়ায় ও নৈঃশব্দ্যে তুলে আনছে শতাব্দ ও সহস্রাব্দের বিগত শোকের অনুনাদ,নাগরিক ধূলো মেখে আছে যুগল চোখে কালিমার ক্লান্তি!রাত্রির অবগুণ্ঠন খসে পড়ে,মেলে দিচ্ছে গুপ্ত বাসনা ও স্বপ্নসমূহ— যাপনের আলে প্রবাহিত করছে অতীত ও বর্তমান যেন কুয়াশার ভেতর অদৃশ্য জল যা তমসাচ্ছন্ন সময়ে উগরে দিচ্ছে মৃত চোখের ছাপে অচেনা ভাষা যে আলোর নিশানা ধরে তলিয়ে যাচ্ছে শাদা কাফন আর কফিনে! 

প্রণয়-মাচান থেকে বেড়ে উঠছে স্নানঘরের ছায়া— নিগূঢ় দর্শনে শর্তহীন দৃষ্টিবাণে চিকচিক করছে বিষমাখা খঞ্জর;প্রত্যাখানের সাহসে ও নির্লিপ্ততায় সচেতন নয় ভুল ও কৃতকর্মে!শুকিয়ে গেছে অশ্রুজল— মরুভূমিতে ফুটে উঠুক ক্যাকটাস,সমূদয় প্রণয়রুচি আর রতিবাসনা ডুবে থাক লবনজলে!প্রেমে ব্যর্থ হয়ে গেলে বিরহ ঝাকিয়ে বসে বসন্তে,মাঘের শীতে— অহেতুক ওড়ে,ভাসে মন যেন একা শঙ্খচিল!

মৃত্যুর দিকে ছুটছে জীবন— আসন্ন দিনে সে আর দেখবে না মায়াবী বিকেল,থাকবে না হেমন্তের অপেক্ষায়;মৌল নিসর্গে তলিয়ে যাবে স্বপ্ন,কাঙ্ক্ষা ও স্মৃতির ইতিহাস!সামষ্টিক এই প্রেম বিগলিত সুরে নিয়ে যাবে অচেনা,অজানা শহরে— যেখানে সমাধিফলক নেই,মৃত্যুরসরবরে মৃত্যুকামী ফুলের বুকে ম্লান করে দেয় আনন্দ ও মর্যাদা!অথচ হাতের মুঠোয় নিয়ে আসা ভাগ্যনির্ধারক মুদ্রা উল্টে দেখি— উভয় পিঠে লেখা মৃত্যু! 

________________________

[] কুরুক্ষেত্রের দেবী

আমার ভেতর স্থায়ী হয়ে আছো তুমি— নিঃশেষবিন্দু ছুঁয়ে দেবার মতো আত্মসমর্পণের আগুন;যেন ক্ষুধার্ত প্রেমিক যে আহার্যে খুঁজে ছিলো ভালোবাসা!বংশীবাদকের সুরের মতো এক লহমা প্রেম— প্রিজনে পাঠানো অগণিত খুন;নীলজলের আকাশ!দস্যি মেয়ে,আমার অনুপস্থিতিতে জ্বালিয়েছো কি চিতার আগুন— ঝিনুকখোলা মুক্তোর দীর্ঘশ্বাস— ভাবলেশহীন,নির্বিকার সময় কোথায় দুলে ওঠে;রহস্যময় সন্ধ্যার বাতাসে?মধ্যরাতের স্নানে কি জুরায় উষ্ণতা নিশ্চুপ প্রার্থনায়— অভিনব ছলচাতুরীতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে জাগছে কি কাঙ্ক্ষিতজনের আকাঙ্ক্ষা?

অদ্ভুত এই নির্জনতা ছিটকে পড়ছে হৃদয়ের ভূগর্ভ থেকে— জবাসমুদ্র জড়ো করছে ফেনিল ঢেউ— পত্রবিহীন ধূসর গাছের পরিত্যক্ত পাখির নীড়;সমস্ত চোখ মার্চপাস্ট করে চিনে নিচ্ছে শ্মশানের বেদী!আঁতুড়ঘরে জন্মেছিলো যে প্রেম— হাঁটিহাটি পায়ে সে-ও বুঝে গেছে স্বাক্ষরহীন এ জীবন;স্বপ্ন দেখা ভুলে গেছে,ভুলে গেছে গান— জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে সুজলা-সুফলা আর শস্য-শ্যামলা বুকের জমিন— আচানক খলবল করে ওঠে স্মৃতির ভেতর ছায়ামূর্তি! 

তোমাকে জেনেছি ক্ষিপ্রগতির অবাধ্য ঘোড়া— যুদ্ধক্ষেত্র ও সমরনীতিতে এক মীরজাফর;গণতন্ত্র এবং সুশাসনের সাথে যার যোজন যোজন দূরত্ব!কুরুক্ষেত্রের দেবী,ন্যায়বিচারের স্বার্থে চোখ দুটো খোলো— আলোকোজ্জ্বল সকালে খাপখোলা তলোয়ারের মতো মন মেলে ধরো;মুঠো খুলে দেখো ফুলের হাসি,উন্মত্ত নখর ঝরে পড়ুক বিশ্বাসী নগরে!শিশির শিহরণে বকুলঘন চকচকে সৌরভে মাখো প্রত্যূষের কোমল আলো— অথচ তোমাকে দেখতে গিয়ে চোখ দুটো পুড়িয়ে ফেলেছি!

__________________________

[] কফিনচোখের শোক

দৃশ্যমান হচ্ছে নীরবতাভেদি বিন্দু যেনবা অচিরেই মুখোমুখি হবে প্রত্যূষের আলোর মতো অতীত ও বর্তমানে যা প্রতিনিয়ত ঢালছে মৃত্যুসুধা!উজিয়ে ওঠা আশ্চর্য এই সুগন্ধী নিশানা ধরে মুছে দেবে কান্নার দাগ— বিগত দিনের ধোঁয়া,কুয়াশার ভেতর শুয়ে থাকা দিন ও রাত্রির পরিত্যক্ত কালীপ্রান্তর!অগণন আত্মহত্যায় উম্মুখ পথ স্রোতের আলে ভেঙে দিচ্ছে ক্ষেতের হাওয়া— অধীতবিদ্যার দাউদাউ শিখার উসকানি যেন পতনের অনুগামী অরণ্যের বিলাপ!স্পর্ধার এই চাদর কেঁপে যাচ্ছে ক্ষুৎপিপাসাহীন স্বস্তির ভেতর— একা দাঁড়িয়ে থাকা সব ফিকে রঙ জড়ো করে;অনুপলে ছুঁয়ে দিতে চাইছে অকস্মাৎ চোখের আবীর— পাথরের গুমোট বুকে ক্রমঘনীভূত আশ্রয়ে!

রূপসী পাখির ডাগরডানার প্রশস্ততায় মেলে দাও ভূগোলে জোছনার নেকাব— মাখিয়ে দাও,মিশিয়ে দাও জনপদে দুধের বিভ্রম;আহত এ মাটি যেনবা প্রিয়ার মুখে কেড়ে নেয়া চাঁদ যে বিপুল মৌনতায় ফিরে আসছে চেনা পথ ধরে!মৃদুভাষে ডেকে নাও সস্নেহের প্রেম— ঘুড়ির চিরচেনা টান;আত্মবিশ্বাসে ভোকাট্টা খাওয়া সেই তীব্র বেগ যা প্রাপকের নামে মুছে দেয় ডাকঘরের প্রতীক্ষা!সন্ধ্যায় জ্বেলে দেয়া প্রদীপের করুণ আলো,তমোহর রাতে ভিখারির মতো দুয়ারে-দুয়ারে ঘুরে চেয়ে আনে বেদনার মোহর!

উন্মাদ বাতাসের দিনে রোদনমুখি নই— প্রেম ব্যর্থ হয়ে গেলে জীবন জানে,এ জীবন খেলাঘর;ভুবনচিলের ডানায় একাকী ওড়ে আকাশ অসীম শূন্যতায় ঠিকানাবিহীন চোখে!অশ্রুগন্ধ বাতাসে যে নিরুদ্দেশের ছাপ মুছে দিচ্ছে সে শহরে ফুটবে না ফুল;মনে জাগবে না প্রেম,চোখে ভাসবে না মায়া— চুমুর খরায় ঠোঁটে মরে যাবে আগুনরঙ!অথচ জীবন ফুরিয়ে যায়— কফিনে উঁকিমারা চোখ,সুবেহ সাদিকের আলোর জন্য রেখে যায় শোক!

_______________________

[] জলপরীর ডানায় যে ভাষা

সবাক এই কবিতা!যুতসই নিঃশব্দবাণীতে ছুঁড়ে দিচ্ছে এক গান বর্তমান ও ভবিষ্যতে— যন্ত্রণাস্তম্ভের হতবাকে কাঁপছে বেদনায় একঘেঁয়ে জীবন!অগণন গন্তব্যের এই ট্রেন লটকে যাচ্ছে দিগন্তের ফাঁদে— অনায়াসে ছুটে যাচ্ছে গোপন ও আড়ালে শতাব্দীর প্রাচীন কবর নিবিষ্ট ভ্রমণকারীর অধরা সুন্দর চোখে;যেনবা সমস্ত অপচয়ের করতল ও চুমুর উদ্ধৃতি!স্বপ্ন এক সমুদ্রজল— উষ্ণ হাওয়ায় ফুলেফেঁপে ওঠে বিলাপবৈরিতায়;শোকগাথায় যে লিখে রাখে মৃত্যুর ঘ্রাণ! 

বিচলিত নই এই রক্ত-বরফ-করা শীতের উপত্যকায়— বিভ্রান্তির বন পাশ এড়িয়ে পরিযায়ী মনে গেঁথেছি স্থির,অটল,সংকল্প!আবর্তনেই মেখেছি উত্তাপ স্বস্তির,আত্মহণনের মতো অনিবার্যতায়— শিশিরের ছোঁয়ায় জেগে ওঠা ঘাস কিংবা পুড়ে যাওয়া পাখিদের পায়ে!খেয়াহীন এই নদী মধ্যাহ্নের সুরে গচ্ছিত প্রহরবিভ্রমে বাইছে কাতর ঢেউ— সাঁতারের অভিলাষে যে মন,সে এক নম্রচেরাগ মৌমাছিদের যা বিঘ্নঋতুকালে গোপন আঁধারে কেটেছে সিঁদ মধুর ভাসানে!

জীবন এক ভ্রান্তজলাধার— জলময়দানে যে দিয়েছে আশ্বাস নিবিড় ঢেউফণায় লেহন-প্রশান্তি;সুরভিত ঢেউয়ে ভেসে আসা সুললিত ফাঁকির মৃদু কোলাহল!কায়মনে দাঁড়িয়ে আছে চোখ— যেন প্রেমপূর্ণভূমির সেই যুগলবাসনা যা জলপরীডানায় ফিরিয়ে আনবে গৌরবের অনার্য আকাশ!মিহিন প্রেমপূর্ণ বাতাসে দূরে সরে যাক হতাশাসমুদ্র— পাঁজরের তোরণে জমা থাক বিস্তীর্ণ অনুভূতি মনের স্বরলিপিতে!যে মৃত্যু ভাষা গিলে খায়,সে ভাষাই ছিলো প্রেম!

One thought on “নজরুল মোহাম্মদ

  • papia Afroz

    প্রতিটি কবিতা পড়ে আপ্লুত হই। কবি ও কবিতার জন্য শুভকামনা সবসময়।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *