গল্প

মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়

কোজাগরী

কোজাগরী পূর্ণিমার চাঁদ একটু-একটু করে গলে মিশে যাচ্ছে সমুদ্রের সঙ্গে। ঝিরঝিরে হাওয়া শিরশিরে শব্দ তুলে ঝাউগাছগুলোকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। সোহাগে, আশ্লেষে ঝাউয়ের পাতাগুলো হাওয়াকে আলিঙ্গন করতে চাইছে। ধরি-ধরি করেও ধরতে পারছে না । ঠিক তার মতো, তাই না?

অপলক দৃষ্টি মেলে দেখছে স্বয়ম। সে-ও পারেনি। যেদিন সব পেতে পারত, সেদিন অবহেলা করে হারিয়েছে। আজ আকুল হয়ে ফিরে পেতে চাইছে। পাবে না, পাবে না। পাওয়া তার হবে না।

কত বছর হলো ? আট, না কি নয়?

ফিরে আয় ঋ। হাহাকার করে ওঠে স্বয়ম।

‘তোমার কী ব্যাপার বলো তো? ফোন করলে ধরছ না। হোয়াটস অ্যাপে টেক্সট রিড করা দূর, ডেলিভার্ড পর্যন্ত হচ্ছে না। কী চাইছ বলো তো?’
স্বয়মের চিৎকারে রায়া খিলখিল করে হেসে উঠে বলে, ‘ফোন ধরছি না? এখন কার সঙ্গে কথা বলছ!’

‘ফাজলামি করিস না ঋ। মাথা কিন্তু গরম আছে। সোজা তোর ফ্ল্যাটে গিয়ে ধুমধাড়াক্কা দু-চার ঘা দিয়ে চলে আসব। সেটা ভাল হবে কি ?’

‘হি হি হি, দারুণ মুডে আছো মনে হচ্ছে। অনেকদিন পর তুই আর ঋ একসঙ্গে। আই রিয়্যালি এনজয় দিস। আমার ফ্ল্যাটে তোমার নো এন্ট্রি, সেটা কতবার বলতে হবে মশাই ?’

‘জানি, জানি। আপাতত তোকে কোনরকম আনন্দ দেবার মুডে নেই। মেজাজ বহুত খারাপ আছে। গতকাল আমার বস কোথাও কিছু নেই, দুম করে একটা কাজ চাপিয়ে দিয়েছে। তাতে এক সপ্তাহের জন্য আউট অফ স্টেশন নিশ্চিত। বলা যায় না, কাজ শেষ করে উঠতে না পারলে তার থেকেও বেশী দিন।’

‘ওলে বাবালে, এইবার বোঝা গেল, বাবুর মেজাজ কেন এত খারাপ। ঠিক আছে বাবা ঠিক আছে। আরে আমরা তো রোজ মিট করি না। এই কটা দিন দেখা না হলে আমাদের প্রেম বাড়বে বৈ কমবে না।’ কথাটা বলে ফোনের এপ্রান্তে রায়া নিজেই নিজের চোখ মটকে দুষ্টুমির মজাটা নিতে চায়।

‘তাহলে চল, আজ আমরা বাইরে কোথাও একটা গিয়ে লাঞ্চ করি। তারপর একটা মুভি দেখে যে যার ফ্ল্যাটে ফিরব।’

স্বয়মের কথায় রায়া খানিকটা চুপ করে থাকে। তারপর বেশ সিরিয়াস গলায় বলে, ‘একটা কথা ভেবে দেখেছ স্বয়ম, কতগুলো দিন পর আমরা আবার কত কাছাকাছি আসতে চাইছি। আমাদের পার্সোনাল লাইফে যাই থাকুক না কেন, আমাদের প্রেমটা একেবারে পাক্কা ।’

রায়ার কথায় ফোনের উল্টোদিকে থাকা স্বয়ম হো হো করে হেসে ওঠে।
‘তোর গোমরাথেরিয়াম বরবাবাজী কোথায় ? তুই এত গদগদ হয়ে আমার সঙ্গে কথা বলছিস?’

‘সে যেখানেই থাক না কেন। এখন তোমার সঙ্গে এভাবে কথা বলছি তাতে তোমার ভাল না লেগে গায়ে জ্বালা ধরছে? বলে দাও, ফোন রেখে দিচ্ছি।’

‘অ্যাই! খবরদার ঋ! অনেকদিন কিছু বলি না বলে খুব বাড় বেড়েছে তোর। আমাকে যে-সে পাসনি। আমার পাওনা ঠিকঠাক বুঝে নিতে জানি ।’

‘সবসময় আমার বরের প্রসঙ্গ টেনো না। ভাল লাগে না আমার। আমি কি তোমার বউয়ের খোঁজ নিই ? না কি জানতে চাই সে তোমার যতœআত্তি করছে ?’

‘আচ্ছা, হয়েছে। মেজাজ খারাপ করতে হবে না। রান্নার মাসী গত দুদিন আসেনি। আজ আসবে কিনা জানি না। তুই আজকের লাঞ্চের প্রোপোজালও অ্যাকসেপ্ট করলি না। অগত্যা নিজেকেই যাহোক একটা কিছু করে নিতে হবে। তাহলে এখন টা টা।’

‘রান্নার মাসী আসছে না বলনি কেন? একটা ফোন করে খোঁজ নিতাম। তুমি চা ছাড়া আর পারো কিছু করতে, যে করবে বলছ?’

‘তুই আর ঝামেলা বাড়াসনি ঋ। এরপর রান্নার মাসী জানতে চাইবে, বউদি এখনো আসছে না কেন? প্লিজ, এসব হ্যাপা আমি নিতে পারব না। বাই।’

‘ওক্কে বাবা। যেমনটা তোমার ইচ্ছা। বাই।’
গুনগুন করে গানের কলি ভাঁজতে ভাঁজতে রায়া কিচেনে ঢোকে। আজ একটা স্পেশাল ডিশ বানাতে ইচ্ছা করছে। কতগুলো দিন পর সে আবার গান গাইছে। তার গলা দিয়ে সুর বেরোচ্ছে। একটা সময় মনে হয়েছিল এই গলা দিয়ে শুধুই ঝগড়া করতে পারে। মনটা বেশ খুশি খুশি লাগছে। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে, জীবনটা এখনো ফুরিয়ে যায়নি। সে এখন কারোর জীবনে একমাত্র ভালবাসা। কোনদিন বেশী কিছু চায়নি। ছিল শুধুমাত্র ভালবাসার কাঙাল।

নাহ্, এসব নিয়ে আর রায়া ভাবতে চায় না। বরং স্বয়মের একটা পছন্দের ডিশ বানিয়ে ওকে একটা সারপ্রাইজ দেবে। বাটার চিকেন বানিয়ে, প্যাক করে নিচে সিকিউরিটির কাছে দিয়ে স্কুলে চলে যাবে। স্বয়মকে শুধু একটা মেসেজ করে দেবে, সে অফিস যাবার পথে লাঞ্চবক্সটা যেন অবশ্য মনে করে নিয়ে নেয়। এটা ভাবার পর রায়ার মনটা আরও ভাল হয়ে যায়।

স্বয়ম চিরকাল কুঁড়ে টাইপ। অন্য কাজ তো দূর, নিজের কাজটুকুও করতে খুব অনীহা। এই কারণে রাজন্যা মানে বউয়ের সঙ্গে অশান্তি। শুধু তাই নয়, প্রতিটা বিষয়ে তার অসন্তুষ্টিও কিছু কম নয়। রায়া তার জীবনে যেদিন প্রকৃত ভালবাসা কী, এই উপলব্ধিটা এনে দিলো সেদিন থেকে একটু একটু করে স্বয়মের নিজেরও পাল্টে যাবার ইচ্ছা, স্পৃহা বেড়েছে।

অনেক কিছু, যা আগে ন্যাকামো লাগত, এখন সেগুলো অন্যভাবে দেখার চোখ তৈরি হচ্ছে তার। ভাললাগা বাড়ছে। মন ভাল থাকছে। রাস্তাঘাটে, অফিসে এখন অযথা ঝামেলা, বিবাদে নিজেকে জড়ায় না। একদিন তো বাথরুমে হেঁড়ে গলা নিয়ে গানও ধরেছিল। তারপর নিজেই হো হো করে বাথরুম কাঁপিয়ে হেসে উঠেছিল। মনে হয়েছে, ভাগ্যিস রাজন্যা নেই। ভাবত, তার বদমেজাজি বর, মেজাজের সঙ্গে সঙ্গে মাথাখারাপের রোগেও আক্রান্ত হয়েছে। কথাটা ভেবে আরও একচোট হেসেছে।

তারপর এক অদ্ভুত ভাললাগায় মন ভরে গেছে। জগৎ সংসারে যা কিছু খারাপ সব ক্ষমা করে দিতে ইচ্ছা করছে। ঋকে অনেক বেশী বেশী ভালবাসতে মন চাইছে। রাজন্যার সঙ্গে কাটানো তিক্ত সময়গুলো মন থেকে চিরতরে মুছে দিতে ইচ্ছা করছে।
ঋ এখনো পর্যন্ত একটা দিনের জন্য তার ফ্ল্যাটে যাবার পারমিশন দেয়নি। স্বয়ম নানাভাবে অ্যাপ্রোচ করেছে। ঋ খুব সুন্দর করে বিষয়টায় পাশ কাটিয়েছে। আসলে ওর বলার ধরণ এতটা দারুণ যে চাইলেও কথাগুলো অন্যভাবে নেওয়া সম্ভব নয়।

‘স্বয়ম, তোমার আর আমার সম্পূর্ণভাবে দেখা হবে একটা মুক্ত পরিবেশে। যেখানে আমাদের কেউ চিনবে না, কেউ জানবে না। শুধু প্রাণভরে আমরা দুজন দুজনকে জানব, কাছে টানব, অচ্ছেদ্য বন্ধনে নিজেদের আবদ্ধ করব। যাতে সেই বন্ধন আমাদের বাকি জীবনে কখনোই না ছিঁড়ে যায়। অন্য কারোর উপস্থিতি তার সুর বেসুরো করে দিতে না পারে।’

এত সুন্দর করে বলা কথার ওপর স্বয়ম আর কিছু বলতে পারেনি। শুধু এখন তার অপেক্ষার পালা। কবে তার ঋ তাকে এই পরিবেশে নিয়ে গিয়ে সারাজীবনের না-বাঁধনে বাঁধবে।

ঋকে সে প্রথমে পাত্তা দেয়নি। ভরসা তো দূর। বেশ খারাপ ব্যবহারও করেছিল। তবে এখন বুঝতে পারে স্বয়ম প্রথম দেখাতেই ঋ ভালবেসে ফেলেছিল। এখন ঋর প্রতি এতটাই আস্থা, সে নিশ্চিত তার আর রাজন্যার দাম্পত্যে কোন সমস্যা কখনো হবে না।

ফোনে মেসেজের টোনে ভাবনা-চিন্তাগুলোকে আপাতত সরিয়ে মেসেজ পড়তে মনোযোগী হয় স্বয়ম। পড়তে পড়তে মুখে হাসি আর মনে খুশি দুই জেগে ওঠে। মেসেজটা ঋ করেছে ।

“বাটার চিকেন বানিয়েছি শুধু তোমার মুখটা মনে করে। সিকিউরিটির কাছে রেখে গেলাম। অফিস যাবার পথে মনে করে নিয়ে যেও। খাওয়ার আগে আমার মুখটা ভেবে নিও। খেয়ে কমপ্লিমেন্ট দিতে ভুলো না যেন।”

আগে এই ধরণের কথা শুনলে স্বয়মের মেজাজ চিড়বিড় করে উঠত। মনে হতো এইসব ন্যাকামো এক চড়ে ঠান্ডা করে দেয়। ঋ তাকে বুঝিয়েছে, ‘একটা কী দুটো আবেগী কথা, সামান্য একটু হাতের স্পর্শ জীবনের ইক্যুয়েশন বদলে দিতে সাহায্য করে। তাই এগুলো ইগনোর নয়, আপন করো।’

একটু-একটু করে অসীম ধৈর্য নিয়ে ঋ তাকে পাল্টে দিয়েছে । আজ স্বয়মের খুশিতে পাগল হয়ে যেতে ইচ্ছা করছে। সাতদিনের অফিস ট্যুরের আজ লাস্ট দিন। আর ঋয়ের কাছ থেকে এমন মেসেজ!

“স্বয়ম, এবার আমাদের সময় হয়েছে সেই মুক্ত পরিবেশে একে অপরের কাছে যাবার। তুমি কাল অফিস ট্যুর থেকে ফিরে সারাদিন রেস্ট করবে। কাল আমাদের কথা হবে না। দেখা হবে পরশু। কোজাগরী পূর্ণিমার চাঁদ যখন সমুদ্রের বুকে ভেসে উঠবে আমরাও একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে যাব। ভুলো না কিন্তু। একেবারে পরশু সন্ধ্যেবেলা ঝাউবনের কোল ঘেঁষে ঢেউ আছড়ে পড়ছে, ঠিক সেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করবে তুমি।”

এই খবরে খুশিতে উদ্বেল না হয়ে থাকতে পারে স্বয়ম?

পিঙ্ক কালারের শিফন শাড়ি আর সাদা নেটের হাইনেক বøাউজ পরে আসতে বলেছে রায়াকে। সে নিজে পরবে ঘন নীল পাঞ্জাবি আর ক্রিম কালারের চুড়ি-পা পায়জামা। আজ সবটুকু সমর্পণ করবে রায়াকে। প্রতিটা ভুল স্বীকার করবে, ক্ষমা চাইবে। নতুন করে শুরু হবে জীবন। ভাবতেই স্বয়মের বুকের ভিতর সমুদ্রের একটা বড়সড় ঢেউ ঝাপটা দিয়ে গেল।

সমুদ্রের ধার ঘেঁষে পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় স্বয়ম। ঋ এসে পৌঁছনোর আগে নিজেকে তৈরি করে নিতে চায়।

বালির ওপর বসে সে। চাঁদের দিকে তাকায় স্বয়ম। বিড়বিড় করে বলে ওঠে, ‘একটু পরে আসবে ঋ। বেশ টেনশন হচ্ছে। কথাগুলো আরও একবার বলেনি। যাতে আর কোন ভুলচুক না হয়।

‘আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ ঋ। তুমি একাধারে আমায় ভালবাসা চিনিয়েছ, তেমন সংসারে মানিয়ে গুছিয়ে চলার আগ্রহ তৈরি করেছ। বিয়ের পর প্রথম একবছর আমি তোমার সঙ্গে যারপরনাই খারাপ ব্যবহার করেছি। সবটা ইচ্ছাকৃত নয়। মাতৃহীন সংসারে মিলিটারী বাবার শাসনে বড় হয়েছি। আদর কম, শাসন আর নিয়মশৃঙ্খলার পাঠ পেয়েছি বেশি। ছোট থেকে আমার প্রকৃতি হয়ে উঠেছে কাঠখোট্টা। প্রথমদিকে তুমি অনেক বুঝিয়েছ, ভালবেসে আপনার করতে চেয়েছ। কিন্তু আমি উল্টো ব্যাখ্যা করে আরও তোমায় অসম্মানিত করেছি।’

বলেছ, আমাদের কিছুদিন আলাদা থাকা উচিত। স্বামী-স্ত্রী নয়, বন্ধুর মতো করে ভালবেসে আমরা একে অপরের সঙ্গে চলতে পারি কিনা সেটা দেখা উচিত। অন্তত সেই চেষ্টাটুকু আমরা একবার করে দেখি।

‘ভাগ্যিস সেদিন গোঁয়ারের মতো আপত্তি না করে তোমার কথা শুনেছিলাম। নাহলে কোনদিন জানা হতো না জীবন এত সুন্দর। এত খুশির। বেঁচে থাকায় এত আহ্লাদ।’
নিবিড় করে ঋকে কাছে টেনে নিয়ে স্বয়ম বলবে, ‘আমার রাজন্যা, আমার রায়া, আমার আদরের ঋকে সঙ্গী করে নতুনভাবে জীবনটা শুরু করব। আমার ঘর আলো হয়ে থাকবে চিরদিনের জন্য। কি রে, থাকবি তো?’
ঋ মুখ গুঁজে দেবে স্বয়মের বুকে।

কিন্তু ঋ এত দেরি করছে কেন?

পরের পর কল করে ঋয়ের ফোনে। ঋয়ের ফোন বন্ধ।

পাগলের মতো বালির ওপর আছাড়িবিছাড়ি খায় স্বয়ম।

না এসেছিল ঋ না এসেছিল তার ফোন।

ফিরে এসে অনেক খুঁজেছিল। থানাপুলিশ পর্যন্ত বাদ দেয়নি। কিন্তু ঋ? যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।

কেটে গেছে আটটা বছর। আজকের মতো প্রতি কোজাগরী পূর্ণিমায় আসে এখানে। সারারাত অপেক্ষা করে।

‘কেন, কেন এমন করলি ঋ?’

স্বয়মের হাহাকার বালির তট পেরিয়ে ঢেউয়ে ধাক্কা খেয়ে মিলিয়ে যায় দিগন্তে।
মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়
কোজাগরী

কোজাগরী পূর্ণিমার চাঁদ একটু-একটু করে গলে মিশে যাচ্ছে সমুদ্রের সঙ্গে। ঝিরঝিরে হাওয়া শিরশিরে শব্দ তুলে ঝাউগাছগুলোকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। সোহাগে, আশ্লেষে ঝাউয়ের পাতাগুলো হাওয়াকে আলিঙ্গন করতে চাইছে। ধরি-ধরি করেও ধরতে পারছে না । ঠিক তার মতো, তাই না?

অপলক দৃষ্টি মেলে দেখছে স্বয়ম। সে-ও পারেনি। যেদিন সব পেতে পারত, সেদিন অবহেলা করে হারিয়েছে। আজ আকুল হয়ে ফিরে পেতে চাইছে। পাবে না, পাবে না। পাওয়া তার হবে না।

কত বছর হলো ? আট, না কি নয়?

ফিরে আয় ঋ। হাহাকার করে ওঠে স্বয়ম।

‘তোমার কী ব্যাপার বলো তো? ফোন করলে ধরছ না। হোয়াটস অ্যাপে টেক্সট রিড করা দূর, ডেলিভার্ড পর্যন্ত হচ্ছে না। কী চাইছ বলো তো?’
স্বয়মের চিৎকারে রায়া খিলখিল করে হেসে উঠে বলে, ‘ফোন ধরছি না? এখন কার সঙ্গে কথা বলছ!’

‘ফাজলামি করিস না ঋ। মাথা কিন্তু গরম আছে। সোজা তোর ফ্ল্যাটে গিয়ে ধুমধাড়াক্কা দু-চার ঘা দিয়ে চলে আসব। সেটা ভাল হবে কি ?’

‘হি হি হি, দারুণ মুডে আছো মনে হচ্ছে। অনেকদিন পর তুই আর ঋ একসঙ্গে। আই রিয়্যালি এনজয় দিস। আমার ফ্ল্যাটে তোমার নো এন্ট্রি, সেটা কতবার বলতে হবে মশাই ?’

‘জানি, জানি। আপাতত তোকে কোনরকম আনন্দ দেবার মুডে নেই। মেজাজ বহুত খারাপ আছে। গতকাল আমার বস কোথাও কিছু নেই, দুম করে একটা কাজ চাপিয়ে দিয়েছে। তাতে এক সপ্তাহের জন্য আউট অফ স্টেশন নিশ্চিত। বলা যায় না, কাজ শেষ করে উঠতে না পারলে তার থেকেও বেশী দিন।’

‘ওলে বাবালে, এইবার বোঝা গেল, বাবুর মেজাজ কেন এত খারাপ। ঠিক আছে বাবা ঠিক আছে। আরে আমরা তো রোজ মিট করি না। এই কটা দিন দেখা না হলে আমাদের প্রেম বাড়বে বৈ কমবে না।’ কথাটা বলে ফোনের এপ্রান্তে রায়া নিজেই নিজের চোখ মটকে দুষ্টুমির মজাটা নিতে চায়।

‘তাহলে চল, আজ আমরা বাইরে কোথাও একটা গিয়ে লাঞ্চ করি। তারপর একটা মুভি দেখে যে যার ফ্ল্যাটে ফিরব।’

স্বয়মের কথায় রায়া খানিকটা চুপ করে থাকে। তারপর বেশ সিরিয়াস গলায় বলে, ‘একটা কথা ভেবে দেখেছ স্বয়ম, কতগুলো দিন পর আমরা আবার কত কাছাকাছি আসতে চাইছি। আমাদের পার্সোনাল লাইফে যাই থাকুক না কেন, আমাদের প্রেমটা একেবারে পাক্কা ।’

রায়ার কথায় ফোনের উল্টোদিকে থাকা স্বয়ম হো হো করে হেসে ওঠে।
‘তোর গোমরাথেরিয়াম বরবাবাজী কোথায় ? তুই এত গদগদ হয়ে আমার সঙ্গে কথা বলছিস?’

‘সে যেখানেই থাক না কেন। এখন তোমার সঙ্গে এভাবে কথা বলছি তাতে তোমার ভাল না লেগে গায়ে জ্বালা ধরছে? বলে দাও, ফোন রেখে দিচ্ছি।’

‘অ্যাই! খবরদার ঋ! অনেকদিন কিছু বলি না বলে খুব বাড় বেড়েছে তোর। আমাকে যে-সে পাসনি। আমার পাওনা ঠিকঠাক বুঝে নিতে জানি ।’

‘সবসময় আমার বরের প্রসঙ্গ টেনো না। ভাল লাগে না আমার। আমি কি তোমার বউয়ের খোঁজ নিই ? না কি জানতে চাই সে তোমার যতœআত্তি করছে ?’

‘আচ্ছা, হয়েছে। মেজাজ খারাপ করতে হবে না। রান্নার মাসী গত দুদিন আসেনি। আজ আসবে কিনা জানি না। তুই আজকের লাঞ্চের প্রোপোজালও অ্যাকসেপ্ট করলি না। অগত্যা নিজেকেই যাহোক একটা কিছু করে নিতে হবে। তাহলে এখন টা টা।’

‘রান্নার মাসী আসছে না বলনি কেন? একটা ফোন করে খোঁজ নিতাম। তুমি চা ছাড়া আর পারো কিছু করতে, যে করবে বলছ?’

‘তুই আর ঝামেলা বাড়াসনি ঋ। এরপর রান্নার মাসী জানতে চাইবে, বউদি এখনো আসছে না কেন? প্লিজ, এসব হ্যাপা আমি নিতে পারব না। বাই।’

‘ওক্কে বাবা। যেমনটা তোমার ইচ্ছা। বাই।’
গুনগুন করে গানের কলি ভাঁজতে ভাঁজতে রায়া কিচেনে ঢোকে। আজ একটা স্পেশাল ডিশ বানাতে ইচ্ছা করছে। কতগুলো দিন পর সে আবার গান গাইছে। তার গলা দিয়ে সুর বেরোচ্ছে। একটা সময় মনে হয়েছিল এই গলা দিয়ে শুধুই ঝগড়া করতে পারে। মনটা বেশ খুশি খুশি লাগছে। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে, জীবনটা এখনো ফুরিয়ে যায়নি। সে এখন কারোর জীবনে একমাত্র ভালবাসা। কোনদিন বেশী কিছু চায়নি। ছিল শুধুমাত্র ভালবাসার কাঙাল।

নাহ্, এসব নিয়ে আর রায়া ভাবতে চায় না। বরং স্বয়মের একটা পছন্দের ডিশ বানিয়ে ওকে একটা সারপ্রাইজ দেবে। বাটার চিকেন বানিয়ে, প্যাক করে নিচে সিকিউরিটির কাছে দিয়ে স্কুলে চলে যাবে। স্বয়মকে শুধু একটা মেসেজ করে দেবে, সে অফিস যাবার পথে লাঞ্চবক্সটা যেন অবশ্য মনে করে নিয়ে নেয়। এটা ভাবার পর রায়ার মনটা আরও ভাল হয়ে যায়।

স্বয়ম চিরকাল কুঁড়ে টাইপ। অন্য কাজ তো দূর, নিজের কাজটুকুও করতে খুব অনীহা। এই কারণে রাজন্যা মানে বউয়ের সঙ্গে অশান্তি। শুধু তাই নয়, প্রতিটা বিষয়ে তার অসন্তুষ্টিও কিছু কম নয়। রায়া তার জীবনে যেদিন প্রকৃত ভালবাসা কী, এই উপলব্ধিটা এনে দিলো সেদিন থেকে একটু একটু করে স্বয়মের নিজেরও পাল্টে যাবার ইচ্ছা, স্পৃহা বেড়েছে।

অনেক কিছু, যা আগে ন্যাকামো লাগত, এখন সেগুলো অন্যভাবে দেখার চোখ তৈরি হচ্ছে তার। ভাললাগা বাড়ছে। মন ভাল থাকছে। রাস্তাঘাটে, অফিসে এখন অযথা ঝামেলা, বিবাদে নিজেকে জড়ায় না। একদিন তো বাথরুমে হেঁড়ে গলা নিয়ে গানও ধরেছিল। তারপর নিজেই হো হো করে বাথরুম কাঁপিয়ে হেসে উঠেছিল। মনে হয়েছে, ভাগ্যিস রাজন্যা নেই। ভাবত, তার বদমেজাজি বর, মেজাজের সঙ্গে সঙ্গে মাথাখারাপের রোগেও আক্রান্ত হয়েছে। কথাটা ভেবে আরও একচোট হেসেছে।

তারপর এক অদ্ভুত ভাললাগায় মন ভরে গেছে। জগৎ সংসারে যা কিছু খারাপ সব ক্ষমা করে দিতে ইচ্ছা করছে। ঋকে অনেক বেশী বেশী ভালবাসতে মন চাইছে। রাজন্যার সঙ্গে কাটানো তিক্ত সময়গুলো মন থেকে চিরতরে মুছে দিতে ইচ্ছা করছে।
ঋ এখনো পর্যন্ত একটা দিনের জন্য তার ফ্ল্যাটে যাবার পারমিশন দেয়নি। স্বয়ম নানাভাবে অ্যাপ্রোচ করেছে। ঋ খুব সুন্দর করে বিষয়টায় পাশ কাটিয়েছে। আসলে ওর বলার ধরণ এতটা দারুণ যে চাইলেও কথাগুলো অন্যভাবে নেওয়া সম্ভব নয়।

‘স্বয়ম, তোমার আর আমার সম্পূর্ণভাবে দেখা হবে একটা মুক্ত পরিবেশে। যেখানে আমাদের কেউ চিনবে না, কেউ জানবে না। শুধু প্রাণভরে আমরা দুজন দুজনকে জানব, কাছে টানব, অচ্ছেদ্য বন্ধনে নিজেদের আবদ্ধ করব। যাতে সেই বন্ধন আমাদের বাকি জীবনে কখনোই না ছিঁড়ে যায়। অন্য কারোর উপস্থিতি তার সুর বেসুরো করে দিতে না পারে।’

এত সুন্দর করে বলা কথার ওপর স্বয়ম আর কিছু বলতে পারেনি। শুধু এখন তার অপেক্ষার পালা। কবে তার ঋ তাকে এই পরিবেশে নিয়ে গিয়ে সারাজীবনের না-বাঁধনে বাঁধবে।

ঋকে সে প্রথমে পাত্তা দেয়নি। ভরসা তো দূর। বেশ খারাপ ব্যবহারও করেছিল। তবে এখন বুঝতে পারে স্বয়ম প্রথম দেখাতেই ঋ ভালবেসে ফেলেছিল। এখন ঋর প্রতি এতটাই আস্থা, সে নিশ্চিত তার আর রাজন্যার দাম্পত্যে কোন সমস্যা কখনো হবে না।

ফোনে মেসেজের টোনে ভাবনা-চিন্তাগুলোকে আপাতত সরিয়ে মেসেজ পড়তে মনোযোগী হয় স্বয়ম। পড়তে পড়তে মুখে হাসি আর মনে খুশি দুই জেগে ওঠে। মেসেজটা ঋ করেছে ।

“বাটার চিকেন বানিয়েছি শুধু তোমার মুখটা মনে করে। সিকিউরিটির কাছে রেখে গেলাম। অফিস যাবার পথে মনে করে নিয়ে যেও। খাওয়ার আগে আমার মুখটা ভেবে নিও। খেয়ে কমপ্লিমেন্ট দিতে ভুলো না যেন।”

আগে এই ধরণের কথা শুনলে স্বয়মের মেজাজ চিড়বিড় করে উঠত। মনে হতো এইসব ন্যাকামো এক চড়ে ঠান্ডা করে দেয়। ঋ তাকে বুঝিয়েছে, ‘একটা কী দুটো আবেগী কথা, সামান্য একটু হাতের স্পর্শ জীবনের ইক্যুয়েশন বদলে দিতে সাহায্য করে। তাই এগুলো ইগনোর নয়, আপন করো।’

একটু-একটু করে অসীম ধৈর্য নিয়ে ঋ তাকে পাল্টে দিয়েছে । আজ স্বয়মের খুশিতে পাগল হয়ে যেতে ইচ্ছা করছে। সাতদিনের অফিস ট্যুরের আজ লাস্ট দিন। আর ঋয়ের কাছ থেকে এমন মেসেজ!

“স্বয়ম, এবার আমাদের সময় হয়েছে সেই মুক্ত পরিবেশে একে অপরের কাছে যাবার। তুমি কাল অফিস ট্যুর থেকে ফিরে সারাদিন রেস্ট করবে। কাল আমাদের কথা হবে না। দেখা হবে পরশু। কোজাগরী পূর্ণিমার চাঁদ যখন সমুদ্রের বুকে ভেসে উঠবে আমরাও একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে যাব। ভুলো না কিন্তু। একেবারে পরশু সন্ধ্যেবেলা ঝাউবনের কোল ঘেঁষে ঢেউ আছড়ে পড়ছে, ঠিক সেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করবে তুমি।”

এই খবরে খুশিতে উদ্বেল না হয়ে থাকতে পারে স্বয়ম?

পিঙ্ক কালারের শিফন শাড়ি আর সাদা নেটের হাইনেক বøাউজ পরে আসতে বলেছে রায়াকে। সে নিজে পরবে ঘন নীল পাঞ্জাবি আর ক্রিম কালারের চুড়ি-পা পায়জামা। আজ সবটুকু সমর্পণ করবে রায়াকে। প্রতিটা ভুল স্বীকার করবে, ক্ষমা চাইবে। নতুন করে শুরু হবে জীবন। ভাবতেই স্বয়মের বুকের ভিতর সমুদ্রের একটা বড়সড় ঢেউ ঝাপটা দিয়ে গেল।

সমুদ্রের ধার ঘেঁষে পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় স্বয়ম। ঋ এসে পৌঁছনোর আগে নিজেকে তৈরি করে নিতে চায়।

বালির ওপর বসে সে। চাঁদের দিকে তাকায় স্বয়ম। বিড়বিড় করে বলে ওঠে, ‘একটু পরে আসবে ঋ। বেশ টেনশন হচ্ছে। কথাগুলো আরও একবার বলেনি। যাতে আর কোন ভুলচুক না হয়।

‘আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ ঋ। তুমি একাধারে আমায় ভালবাসা চিনিয়েছ, তেমন সংসারে মানিয়ে গুছিয়ে চলার আগ্রহ তৈরি করেছ। বিয়ের পর প্রথম একবছর আমি তোমার সঙ্গে যারপরনাই খারাপ ব্যবহার করেছি। সবটা ইচ্ছাকৃত নয়। মাতৃহীন সংসারে মিলিটারী বাবার শাসনে বড় হয়েছি। আদর কম, শাসন আর নিয়মশৃঙ্খলার পাঠ পেয়েছি বেশি। ছোট থেকে আমার প্রকৃতি হয়ে উঠেছে কাঠখোট্টা। প্রথমদিকে তুমি অনেক বুঝিয়েছ, ভালবেসে আপনার করতে চেয়েছ। কিন্তু আমি উল্টো ব্যাখ্যা করে আরও তোমায় অসম্মানিত করেছি।’

বলেছ, আমাদের কিছুদিন আলাদা থাকা উচিত। স্বামী-স্ত্রী নয়, বন্ধুর মতো করে ভালবেসে আমরা একে অপরের সঙ্গে চলতে পারি কিনা সেটা দেখা উচিত। অন্তত সেই চেষ্টাটুকু আমরা একবার করে দেখি।

‘ভাগ্যিস সেদিন গোঁয়ারের মতো আপত্তি না করে তোমার কথা শুনেছিলাম। নাহলে কোনদিন জানা হতো না জীবন এত সুন্দর। এত খুশির। বেঁচে থাকায় এত আহ্লাদ।’
নিবিড় করে ঋকে কাছে টেনে নিয়ে স্বয়ম বলবে, ‘আমার রাজন্যা, আমার রায়া, আমার আদরের ঋকে সঙ্গী করে নতুনভাবে জীবনটা শুরু করব। আমার ঘর আলো হয়ে থাকবে চিরদিনের জন্য। কি রে, থাকবি তো?’
ঋ মুখ গুঁজে দেবে স্বয়মের বুকে।

কিন্তু ঋ এত দেরি করছে কেন?

পরের পর কল করে ঋয়ের ফোনে। ঋয়ের ফোন বন্ধ।

পাগলের মতো বালির ওপর আছাড়িবিছাড়ি খায় স্বয়ম।

না এসেছিল ঋ না এসেছিল তার ফোন।

ফিরে এসে অনেক খুঁজেছিল। থানাপুলিশ পর্যন্ত বাদ দেয়নি। কিন্তু ঋ? যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।

কেটে গেছে আটটা বছর। আজকের মতো প্রতি কোজাগরী পূর্ণিমায় আসে এখানে। সারারাত অপেক্ষা করে।

‘কেন, কেন এমন করলি ঋ?’

স্বয়মের হাহাকার বালির তট পেরিয়ে ঢেউয়ে ধাক্কা খেয়ে মিলিয়ে যায় দিগন্তে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *