রওশন রুবী
কফিমগ
অমিতা ম্যাডাম ভীষণ রকম চা, কফি পছন্দ করেন। প্রতি মাসে একটি কফি মগ বদল করেন। অনেকেই তাকে কোন না কোন বিশেষ দিনে বা এমনি কফিমগ গিফ্ট করেন। এতে তিনি ভীষণ খুশি হন। অফিসের সবাই জেনে গেছে তার দূর্বলতা মগের প্রতি।
প্রতি দু’ঘন্টা অন্তর কফি পান করেন এবং দুপুরে ডিনারের পরও তার লিপিস্টিক বিন্দু মাত্র এদিক ওদিক হবে না।
শ্রাবণ অনেক চেষ্টা করেও জানতে পারেনি তিনি অফিসে বসেও ঠোঁটে লিপিস্টিক ঘষে নিচ্ছেন কি না।
এই অমিতা চৌধুরীকে কেউ অমিতা, কেউ বা অমিতা ম্যাডাম, কেউ অমি বলেই ডাকে। অফিসের সবাই অমিতা ম্যাডাম ডাকে। শ্রাবণও অমিতা ম্যাডাম ডাকে। তবে “অমি” ডাকটা তার কাছে সফট এবং আন্তরিক লাগে।
প্রায় দু’বছর হলো তিনি আয়কর অফিসে যোগদান করেছেন। যোগদানের পর থেকে অফিসের চেহারাই বদলে দিয়েছেন। প্রতিজন কর্মকর্তা এবং স্টাফ পর্যন্ত বদল হাওয়ার আওতায়।
তার ছিমছাম শরীরে শাড়িগুলো তারের চেয়ে টানটান হয়ে কী করে ঘন্টার পর ঘন্টা থাকে। এরহস্য সবার অজানা। অমিতা ম্যাডাম কী করে এতো পরিপাটি থাকে এটা ভেবে অনেকের ঘুম হারাম হয়। প্রতিজন সুযোগ পেলেই এই টপিকস্ নিয়ে নিচু গলায় কথা বলেন। তার চুল থেকে পায়ের নখ, সব কিছুতেই বিশেষ যত্নের ছাপ।
এসব দেখে বুঝা যায় অতিমাত্রার ধৈর্যশীল তিনি। তার ধৈর্য অফিসের কাজেও পরিলক্ষিত। এসে কাজ শুরু করেন, পাঁচটা বাজলেও কাজ শেষ হয় না।
কর্ম দিনগুলোতে তিনি তার পোশাকের সাথে ম্যাচ করে জুয়েলারি, ঘড়ি, জুতো, নেইলপলিশ, ব্যাগ, হেয়ার ক্লিপ, টিপ ব্যবহার করেন। মাসের বিশদিন, একেকদিন একেকটা।
টিপ পরা তার একটা হবি। তার কপালের দিকে তাকালে বুঝা যায় এ-কপাল টিপহীন বেমানান।
গেলো ক’মাস আগে ম্যাডামের এক বোন এসেছিলেন অফিসে। মজার ব্যাপার হলো তিনিও ম্যাডামের স্টাইলেই চলা-ফেরা করেন। তার এক বন্ধু এসেছিল। অবাক কান্ড! তিনিও একিরকম।
তিনি এপর্যন্ত যা গয়না পরেছেন, সেগুলো এতো বেশি ঝকমকে না, একদম সিম্পল। বাসায় দাওয়াত খেতে গিয়েছিল অফিসের সবাই। কথায় কথায় জানাগেল, তারা এক সাথে কেনা-কাটা করেন এবং একিরকম কেনেন। উনাদের কেনা প্রত্যেকটা জুয়েলারিই ইউনিক। এসব নাকি ওনারা বেশির ভাগ সময় অডার করে আনান।
আজ ম্যাডাম একটা হালকা ফিরোজা কালারের শাড়ি পরেছেন। শাড়ির সাথে ম্যাচ করে যে জুয়েলারি পরেছেন শ্রাবণ গতমাসে অঞ্জন থেকে তা কিনেছে তার বোনের জন্য। পছন্দ মিলে যাওয়ায় সে ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে পরম তৃপ্তি পেল।
শ্রাবণ চায় দিনে তিনি তাকে দু’চারবার বকা-ঝকা করুক। ইচ্ছে করেই অনেক ভুল করে সে সেই জন্য। এখন এই নিয়ে চারবার তদারকি করেছেন তার রেজিস্টারের কাজ। প্রতিবারই তাকে বলেছেন, ” পাবলিকের কাজগুলো আগে করুন। কোন পাবলিক যেন কাজ নিয়ে দাঁড়িয়ে না থাকে। ল’ইয়ারেরগুলো পরে তুলবেন।”
শ্রাবণ অমিতা চৌধুরী কথা বলার সময় কাজ থামিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে প্রতিবারই শুনেছে। কিন্তু তিনি যখন তার অফিস কক্ষে ঢুকে যান। তখন সে ল’ইয়ারের দেয়া ফরমগুলো রেজিস্টারে তোলেন।
এতে পাবলিকের ভিড় বাড়তেই থাকে। ভিড়ের সাথে গুঞ্জনও। মানুষ একত্রিত হলে কথা গলগল করে বেরোয় জানে শ্রাবণ। বেরুক। আরো বেরুক। মেডামের বারোটা বেজে যাক। তারপর বকা-ঝকা। ঐ সুন্দরকে দৃষ্টি সীমায় পাওয়া। বেশ হবে।
অমিতা চৌধুরীর কাছে পাঁচটি আয়কর ফরম নিয়ে সই করানোর জন্য গেলেন শ্রাবণ। তিনি সাক্ষর করতে করতে বললেন, “পাবলিকদের ধরে রাখছেন কেন? বারবার বলেছি ল’ইয়ারদের ফরম পরে রেজিস্টারে তুলবেন। সমস্যা কোথায়?”
“সমস্যা নেই ম্যাডাম। এতো কাজ আমি শেষ করতে পারছি না। ধৈর্য ধরতেই হবে।”
“পাবলিকের ভিড় কমালে কাজে মনোনিবেশ করতে পারবেন। তাছাড়া পাবলিক যতক্ষণ কাজ শেষ না হবে ততক্ষণ কথা বলতে থাকবে। এতে অন্যদের কাজেও ক্ষতি হচ্ছে। এখনি গিয়ে ওনাদের কাজগুলো আগে করুন।”
শ্রাবণ দেখলো তার চালাকি প্রায় ধরে ফেলেছে অমিতা ম্যাডাম। সে আর পাবলিককে ঝুলিয়ে রাখতে পারবে না। মনে মনে বুদ্ধি করে কী করা যায়?
সই করা কাগজগুলো নিয়ে ফিরতে গিয়ে অমিতা ম্যাডামের প্রাণপ্রিয় কফিমগটা ফেলে দিলো। নিচে পড়ে মগটি চিৎকার শুরু করল। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেলেন অমিতা ম্যাডাম। কঠিন চোখে শ্রাবণের দিকে তাকালেন।
“আাপনি বোধ হয় অসুস্থ? দু’দিন ছুটি নিয়ে নিন।”
“সরি ম্যাডাম। ভুল হয়েছে।”
শ্রাবণ অমিতা ম্যাডামের কঠিন চোখের দিকে তাকিয়ে দায়সারা বলে। রুম থেকে বেরিয়ে আসে। সে সব সময় বকা শুনতে চায়। বাট এমন কঠিন চোখ দেখতে চায় না। এই চোখ হায়েনার চোখের চেয়েও তী²।
এঘটনার পর শ্রাবণ আর অমিতা ম্যাডামকে বিরক্ত করেন না। তিনি যেভাবে বলেন, সে ভাবেই কাজগুলো করছেন। প্রতি মুহ‚র্ত একজোড়া কঠিন চোখ বুক কাঁপায়।