সোহেল মল্লিকের ‘মজার পড়া ৫০ ছড়া’
আমীরুল ইসলাম
তিনি একজন পূর্ণাঙ্গ ছড়াকবি। যখন ছড়া লেখেন তখন সেটা ছড়াই হয়ে ওঠে। যখন কবিতা লিখেন তখন সেটা কবিতা হয়। ছড়া-কবিতার এই সুস্পষ্ট বিভাজন তিনি মান্য করেন। তার রচনাসমূহের প্রতি সুদৃষ্টি না দিয়ে উপায় নাই। তার লেখা সচেতন পাঠকের ভালোবাসায় ঋদ্ধ। তার বইগুলো খুবই সুগ্রন্থিত। ব্যক্তিগত ব্যবহারেও তিনি অতি অমায়িক। মধুর ব্যবহার তার। রুঢ় কোন কথা বলেন না। পেশায় একজন আইনজীবি। ছড়াকবিই হতে চান তিনি মনে প্রাণে। শিশুসাহিত্যিকদের সাথে তার অত্যন্ত সদ্ভাব।
প্রতিজনের জন্মদিনে তিনি ফেসবুকে চমৎকার সব পোস্ট দিয়ে থাকেন। একটি জোড়াছবি তিনি প্রকাশ করেন। তার সাথে জন্মদিনে সেই বিশেষ ব্যক্তির ছবি। পুরো ফ্রেমের চশমা পরেন। যখনই দেখা হয় তার হৃদয়ের উষ্ণতা টের পাই। তিনি সাধ্যমত শিশুসাহিত্যিকদের খোঁজ খবর রাখেন। তাদের বই সংগ্রহে রাখেন। যদিও নিজে খুব অসুস্থ। তবুও শিশুসাহিত্যিকদের প্রতি তার মমতার শেষ নাই। ভালোবাসার এই মানুষটার নাম সোহেল মলিক।
সোহেল মলিক ‘মজার পড়া ৫০ ছড়া’ বইয়ের জন্য এসিআই -আনন্দ আলো শিশুসাহিত্য পুরস্কার পান। পুরস্কার গ্রহণের দিন তিনি সাথে মাকে নিয়ে আসেন। মিষ্টি হেসে আমাকে বললেন, আমার পুরস্কার প্রাপ্তিতে মা’ই সবচেয়ে বেশী খুশি হন। তাকে সাথে নিয়েই পুরস্কার গ্রহণ করতে চাই। তার এই শ্রদ্ধা-ভালোবাসার হৃদয়টার মধ্যে লুকিয়ে আছে প্রকৃত শিশুসাহিত্যিকদের পরিচয়।
‘মজার পড়া ৫০ ছড়া’ সোহেল মলিকের একটি উল্লেখযোগ্য ছড়াগ্রন্থ। ‘ছড়া’ শিরোনামে তিনি ছড়াই লিখতে চান। হালকা চালের পদ্য লিখতে তার আপত্তি।
শুদ্ধ ছন্দ, বিষয় নির্ধারনে পার্থক্য, অন্ত্যমিলে পরিশুদ্ধবাদী, তার ছড়া খুবই আনন্দময়। ৫০ টা ছড়ার মধ্যে বিষয়ের কোন পুনরাবৃত্তি নাই। প্রতিটি ছড়াই সুন্দর। কোন ছড়া রেখে কোন ছড়ার কথা বলব! আধো আধো বোল, দোল দোল দুলুনি, বেলুন, ফড়িং, ম্যাও, চিড়িয়াখানা, বাবুই, টম অ্যান্ড জেরি, পুসি আর ঘেউ, ব্যাঙের ছাতা– এসব তার অপূর্ব ছড়া। ছড়ার শর্ত মান্য করে সোহেল মলিকের ছড়াগুলো হয়ে উঠেছে চিরকালের ছড়া।
বারবার তার ছড়া পড়ি। আর ছড়াগুলোর রেশ রয়ে যায় মনের ভেতর।
সোহেল মলিক হৃদয় ও মনন দিয়ে ছড়া লিখেন। তাই ছড়া মনকে ছুঁয়ে যায়। তার ছড়া কৃতিম নয়। তিনি বানিয়ে তুলতে চান না। সহজভাবে নির্মিত হয় তার ছড়া।
দু’চারটে উদাহরণ দেয়ার লোভ হচ্ছেঃ
১.
দুইতলা এক বাসা দেখো
তালের গাছে ঝোলা
সেই বাসাতে দরজা এবং
জানলা আছে খোলা।
এই বাসাটার মালিক কে গো
সেই কথাটা বলি–
বুয়েট থেকে পাশ করা নন;
বাবুই প্রকৌশলী।
২.
টিকিটিকি
ঠিক ঠিকই
কথা বলে রোজ
যদি তার
পেটে পড়ে
হোমোপ্যাথি ডোজ।
আর যদি
দাও রাতে
ভাজা ডিমপোজ
টিকটিকি
ঠিক ঠিকই
সেরে ফেলে ভোজ।
কিংবা
৩.
ইষ্টিকুটুম মিষ্টিমুখে
বিষ্টিভরা রাতে
বিশটি ঘরে মিষ্টি ছড়ায়
লিস্টি নিয়ে হাতে।
এই তিনটা ছড়ার উদাহরণ পেয়ে পাঠকমাত্রই সু¯পষ্টভাবে বুঝতে পারবেন সোহেল মলিকের ছড়ার বৈশিষ্ট্য। ‘মজার পড়া ৫০ ছড়া’য় প্রকৃতপক্ষে মজার মজার ৫০ টি ছড়া আছে।
সোহেল মলিকের সাফল্য হচ্ছে– তিনি মজার ছড়া লিখতে পারেন। মজার ছড়া মানে হাস্যরস বা লঘু কৌতুক নয়। মজা আর হাস্যরসের মধ্যে সুক্ষè পার্থক্য হয়তো আছে। সেই পার্থক্য সচেতনভাবে সোহেল মলিক মেনে চলেছেন।
সোহেল মলিকের ছড়ার বাক্যগুলি লক্ষ্য করলে বোঝা যায় তিনি সৎ ছড়া নির্মাণে কতোটা আত্মনিবেদিত। ছড়ার শব্দের বাইরেও তিনি মজা করার জন্য অনেক লঘু ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করেছেন। তাতে ছড়া অনেক বেশি গতিময় ও আনন্দময় হয়ে উঠেছে।
সোহেল মলিক একজন স্বার্থক ছড়াকার। আমাদের দেশে স্বার্থক ছড়াকারের বড় অভাব। লঘু চালের পদ্য ও কবিতাকে ছড়া বলে চালিয়ে দেই। স্বার্থক ছড়া আমরা শনাক্তও করতে পারি না আজকাল।
মলিককে অভিনন্দন। তিনি একজন স্বার্থক ছড়াকার।