বুক রিভিউ

হেঁটে যায় আদিমাতা: প্রকৃতির সাথে জীবনের নিবিড় পাঠ

আলাউল হোসেন

শিরোনাম- হেঁটে যায় আদিমাতা।
কবির নাম- নুরুল ইসলাম বাবুল।
বইয়ের ধরণ- কাব্যগ্রন্থ।
প্রকাশকাল- আগস্ট ২০২০।
প্রকাশক- প্রতিভা প্রকাশ, ঢাকা।
প্রচ্ছদ- সঞ্জিব রায়।
মূল্য- ১৩৫ টাকা।

কবি নুরুল ইসলাম বাবুলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আমার প্রথম’ (২০০৩) প্রকাশের দীর্ঘকাল পরে প্রকাশিত হলো দ্বিতীয় কবিতার বই ‘হেঁটে যায় আদিমাতা’ (২০২০)। আগের গ্রন্থের তুলনায় অনেক বেশি পরিনত চল্লিশটি কবিতায় সমৃদ্ধ গ্রন্থটি নতুন চিন্তার খোরাক। কবি মানুষের মন ও মননে, চিন্তা ও চেতনার জগতে যেমন ঢুকতে চেয়েছেন, তেমনি আবিস্কার করতে চেয়েছেন মানব হৃদয়ের বিকশিত হয়ে ওঠার আকুতি। পরিশুদ্ধ হৃদয় মাত্রই হয়ে উঠতে চায় ফলবতী বৃক্ষ, যা জীবনকে সার্থক আর সুন্দর করে। কবির ভাষায়-
‘কিছু প্রার্থনা নিবিড়তা খোঁজে; জলের নিয়মে চায় মাটির সখ্যতা। আমরা
তো জানি কতটা আদ্রতায় অঙ্কুরোদগম হয় রোপিত বীজ।… তবু
প্রতীক্ষা কতক্ষণ দীর্ঘ হলে প্রার্থনার সময় সঠিক হবে জল ও মাটির গুণন।
কেননা আমাদের হৃদয় আজ বৃক্ষ হতে চায় অঙ্কুরোদগমের চিরায়ত কানুনে।’
(বৃক্ষ জার্নাল/ হেঁটে যায় আদিমাতা)

প্রকৃতির সাথে মানুষের জীবন গেঁথে আছে নিবিড়ভাবে। প্রকৃতির ঋতু বদলে যেমন পাল্টে যায় পরিবেশ-পরিস্থিতি, মানুষের জীবনেও রয়েছে নানারকম উত্থান-পতন। রয়েছে ভাঙা-গড়া। বসন্তবাতাসে যেমন মানুষের মনে জাগতে পারে নব প্রেমের দোলা, বৈশাখী তান্ডবে তেমনি এলোমেলো হয়ে যেতে পারে সাজানো জীবন্ । কবির ভাষায়-
‘অত:পর টিকে যাওয়া জীবনের এই প্রেম
ঋতুচক্রে আবর্তিত এই খেলাঘর
বৈশাখ করে দেয় কিছু এলোমেলো
মৃদু হয় কোকিলের স্বর।’
(বৈশাখের পদাবলি/ হেঁটে যায় আদিমাতা)

নুরুল ইসলাম বাবুল তাঁর কোনো-কোনো কবিতায় মহাজীবন প্রবাহের সাথে বিশ^-ব্রম্মান্ডের বাস্তব আর পরাবাস্তব রস সংযোগ ঘটিয়ে চমৎকার এক চিত্রকল্প তৈরি করেছেন। তেমনি একটি কবিতা-
‘ঘুমের গন্ধ পেয়ে রাতের শয্যায় শোয় ক্লান্ত বিকেল
বংশপরম্পরায় এই রাত এই বিকেল এই ঘুম
চষে বেড়ায় নক্ষত্রের আলো-

নিরবতা… শুন্যতা…স্তব্ধতার আস্বাদ;

তবু কিছু স্বপ্ন জমে থাকে অতিক্রান্ত সময়ের কাছে
কিছু প্রেম বিকশিত হতে হতে কিশোরীর চুরি ভাঙে
এবং ভাঙার শব্দে হেসে লুটোপুটি খায় লতাপাতাঘাস।’
(অলিখিত কলঙ্কের দাগ/ হেঁটে যায় আদিমাতা)

এই গ্রন্থের শিরোনাম কবিতায় কবি তুলে ধরেছেন মানুষের সবচেয়ে আদিমতম ইতিহাস। আর তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন বংশ পরম্পরায় আমরা একই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলেছি। কবি নিজেও এই পথের ভিন্ন পথিক নয়। তাঁর ভাষায়-
‘বাতাসে উড়িয়ে চুল হেঁটে যায় আদিমাতা
আমি তাঁর চুলের গন্ধ শুঁকে-শুঁকে
খেয়ে ফেলি নিষিদ্ধ গন্ধম…’
(হেঁটে যায় আদিমাতা/ হেঁটে যায় আদিমাতা)

আমরা তো নয়-ই কবি নিজেও যখন এ কথা বলেন কবিতার শেষ পংক্তিতে তখন আর উপায় কী আমাদের-
‘এ মনে লাগে উদাসী হাওয়া
তবু পেরুতে পারি না সংসারের চৌকাঠ
ডিঙানো হয় না সামাজিক প্রথা;’

আমরা তো সাধারণ। আমরা তো সহজেই পাঠ করতে পারি না কবির অন্তরের গভীরতর বেদনা। কবিকে আবিস্কার করা যে সহজ নয়। তা করতে হলে ডুবতে হয়, ডুবে যেতে হয় কবির সৃষ্টিকর্মের অতল সমুদ্রে। ডুবতে-ডুবতে একটু হলেও চেনা যেতে পারে কবির অন্তহীন দুঃখের কিছু অংশ। নুরুল ইসলাম বাবুল মনে করেন প্রতিটি মানুষ ভেতরে-ভেতরে বড় বেশি নিঃসঙ্গ, খুব বেশি একা। নিজের ভেতরের নিরন্তর দহন নিজেকেই পোড়ায়, অন্য কেউ তার অংশীদার হতে পারে না। কেননা এ আগুন তার একান্তই নিজস্ব। কবিও এই অন্তর্জালা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। তাই তিনি উচ্চারণ করেন-
‘এইভাবে কেটে যাচ্ছে দিন
নিজের আগুনে পুড়ে-পুড়ে।’
(নিজের আগুনে/ হেঁটে যায় আদিমাতা)

হৃদয় দগ্ধ করা এ আগুন থাকবেই। কেননা, মানবজীবন টিকে থাকে মহাসংগ্রামের ভেতর দিয়ে। এ জীবনে সুখ আছে। দুঃখ আছে। ঝড় আছে। সুবাতাসও আছে। বিপদ যতই আসুক না কেন নিজেকে শক্ত করে দাঁড়াতে হবে। নত হয়ে পড়ার নাম জীবন-সংগ্রাম নয়। বাবুল সে কথা বলেছেন তাঁর ‘প্রতিদিন’ শিরোনামের কবিতায়। পাঠ করা যাক কবিতাটির কিছু অংশ-
জীবনে আসে বারবার মহাঝড়
থাকতেই পারে বুকে ভাঙনের ক্ষত
ভেঙেছে ভাঙুক ক্ষুদ্র মাটির ঘর
তা বলে হয়ো না বেদনার কাছে নত।

আমরা দেখেছি কবি নুরুল ইসলাম বাবুলের বেশ কিছ কবিতায় সত্য ও মিথ্যা, সুন্দর ও অসুন্দর, আগুন ও আঁধার, বিশ্বাস ও অবিশ্বাস নানাভাবে চিত্রায়িত হয়েছে। কবিতাগুলো গভীর মনোযোগসহ পাঠ করলে জানা যায় আসলে কী বলতে চান কবি। কী বলতে চান সে কথা জানার আগে আমরা পড়ব কবির আরও একটি চমৎকার কবিতা-
‘চেনা মুখগুলো কী সুন্দর বদলে যায়
আঁধারের আড়ালে…
এক অলিখিত লিয়াঁজোর চক্রান্তে
লুট হয় আমাদের প্রিয় নদী
ক্ষত ও খুনের স্বাক্ষী থাকে অগণন মরা মাছ;
বিশ্বাসী চোখগুলো কেবল সূর্যের সমর্থন চায়।’
(বিশ্বাসী চোখগুলো/ হেঁটে যায় আদিমাতা)

নুরুল ইসলাম বাবুলের একটি উল্লেখযোগ্য কবিতার শিরোনাম ‘সবকিছু মিথ্যা হয়ে যায়’। আসলে কী মিথ্যা হয়ে যায়। কেন মিথ্যা হয়ে যায়। কবি নুরুল ইসলাম বাবুল সে কথা জানাতে চায় তাঁর কবিতার মধ্য দিয়ে। নিরাশার ভেতর দিয়ে কবি খোঁজেন আশার আলো। হিংসা-দ্বেষ, লোভ ও লাভের হিসেব চিরকাল ধরে রাখা যায় না। জীবনের প্রচন্ড প্রতাপও একদিন ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু এই যে বেঁচে থাকা, এই যে মহাজীবন প্রবাহ- এর ভেতরের অপাঙক্তেয় আঁধার থেকে কবি মুিক্ত চান, সবাইকে মুক্ত দেখতে চান। অন্ধকারে জ¦ালাতে চান আলো। তাই তিনি তাবৎ অন্ধকারেও আলোকবর্তিকার কবি। ‘হেঁটে যায় আদিমাতা’ কাব্যগ্রন্থ সেই বার্তা বহন করছে। প্রতিটি কবিতায় ছড়িয়ে আছে মুগ্ধতা। পাঠককে টেনে রাখে দারুণ এক মোহের ভেতর। সফল হোক কবির তাবৎ চেষ্টা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *